সোমবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৩



গদ্য কবিতার ছন্দ


গদ্য কবিতার ছন্দ/ শেখ জলিল

বাংলা কবিতার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। যুগে যুগে এর বিষয়
, আঙ্গিক, ছন্দেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। সেই যে চর্যাপদ থেকে যার যাত্রা শুরু তা এখন ঠেকেছে অতি আধুনিকতায়। আর এ আধুনিক কবিতার মূল বিবর্তন এসে স্থিত হয়েছে গদ্যছন্দে। তাইতো গদ্যছন্দেই লিখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন আধুনিক কবিরা।

আসলে গদ্য কবিতাই বা কী
, গদ্যছন্দই বা কী? এককালে আমরা ছন্দোবদ্ধ অন্তমিলযুক্ত বর্ণনাকে পদ্য বলে জেনেছি। কিন্তু বর্তমানে কবিতার বিশালতায় এর ছন্দ, অন্তমিল, উপমা, চিত্রকল্প কিংবা শারীরিক গঠনে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। স্বরবৃত্ত্, মাত্রাবৃত্ত বা অক্ষরবৃত্ত ছন্দ নিয়ে কতো বিচিত্র প্রয়োগই না করছেন আধুনিক কবিরা। অক্ষরবৃত্তের পয়ার থেকে চতুর্দশপদী, অমিত্রাক্ষর, মুক্তক ছন্দের যে বিবর্তন, সে বিবর্তনের ধারায়ই এসেছে গদ্যছন্দ।

গদ্যকবিতা বা গদ্যছন্দের শুরু হয় রবীন্দ্র যুগেই। রবীন্দ্র বলয় থেকে বেরিয়ে
এসে যে ক'জন সমাজতন্ত্রী কবি গদ্যছন্দের প্রবর্তন করেন তাদের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-ই সবচেয়ে সফল। অবশ্য এর মধ্যেই বিষ্ণু দে প্রবর্তিত এক ধরনের গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। মূলত ত্রিশের দশকের কবিদের হাতেই ঘটে গদ্যছন্দের ব্যবহার।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
, কাজী নজরুল ইসলাম এবং জীবনানন্দ দাশ প্রথম প্রথম এর বিপক্ষে ছিলেন। প্রতিবাদস্বরূপ রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পাদিত একটি পত্রিকায় গদ্যছন্দের কবিতা প্রকাশ বন্ধ রাখেন। কাজী নজরুল ইসলামতো ব্যঙ্গ করে একটি কবিতাই লিখে ফেলেন। অথচ জীবদ্দশাতেই রবীন্দ্রনাথ একে অনুমোদন দিয়ে গেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের হাতেও ঘটেছে কবিতায় গদ্যরীতির সাধুবাদ। রবীন্দ্রনাথের 'রূপনারানের কূলে জাগিয়া উঠিলাম', নজরুলের 'লাথি মার, ভাঙরে তালা' কিংবা জীবনানন্দের 'যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি চোখে দেখে তারা' বাংলা কবিতায় গদ্যরীতির সফল প্রয়োগ। বিশ্বকবির 'হঠা দেখা' বা বিদ্রোহী কবির 'আমার কৈফিয়ত' কৃষ্ট সুন্দর গদ্যকবিতা।

যা বলছিলাম ত্রিশের কবিদের কথা- বিষ্ণু দে
, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু সবাই ছিলেন গদ্যকবিতার অগ্রযাত্রী। এর মধ্যে সুধীন্দ্রনাথের গদ্যরীতিই কবিতায় সফলতা এনেছে। পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের দু'জন কবি হাসান হাফিজুর রহমান এবং শহীদ কাদরী কবিতায় গদ্যরীতির প্রবর্তন করেন। এর মধ্যে শহীদ কাদরীর গদ্যরীতি সবচেয়ে সফল, আটসাঁট এবং উল্লেখযোগ্য।

গদ্যকবিতার ছন্দ বা গদ্যছন্দ আসলে কী
? নতুন কবিরা যখন আধুনিক কবিতা পড়েন তখন এর অন্তর্নিহিত ছন্দ খুঁজতে গিয়ে হিমশিম খান। অনেকে গদ্যকবিতাকে ছন্দহীন কবিতা ভাবতে থাকেন। কিন্তু গদ্যকবিতার ইতিহাস অনেক বিশাল। শুরুতেই বলেছিলাম পয়ার থেকে এর যাত্রা শুরু। অক্ষরবৃত্তের মুক্তক ছন্দে এসে এর নতুন বিবর্তন হয়েছে গদ্যছন্দে। তাই গদ্যছন্দের মূল স্বাদ আস্বাদনে সব কবিকেই চষতে হয় অক্ষরবৃত্ত ছন্দের বিশাল জমিন।

গদ্যকবিতার রীতি একেক কবির কাছে একেক রকম। আধুনিক যে কবিরা গদ্যছন্দে সফলতা
পেয়েছেন তারা সবাই প্রথম অক্ষরবৃত্তে লিখে হাত পাকিয়েছিলেন। আর তার ফলশ্রুতিতে তারা পেয়েছেন কবিতায় তাদের নিজস্ব গদ্যরীতি। হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ কাদরী ছাড়াও শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ প্রমুখ কবি গদ্যকবিতার অন্যতম পথিকৃত। ষাট ও সত্তর দশকের আবুল হাসান, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং আবিদ আজাদ ছিলেন বেশ সফল।

কেউ বলেন
, উপমাই কবিতা। কেউ বলেন চিত্রকল্প, কেউ বলেন অতীন্দ্রিক ভাবনা; আবার কেউ বলেন বাস্তবের সাথে কল্পনার সংমিশ্রণ। আবার নতুন করে কাউকে কাউকে বলতে শুনি- যা গদ্য নয় তাই কবিতা। এ কথার সাথে অবশ্য ছড়া, পদ্য বা লিরিকের একটা দ্বন্দ চলে আসে তখন। আসলে কবিতা অনেক বিমূর্ত, অনেক ভাবনাবহুল। গদ্যকবিতার বা গদ্যছন্দের কথা বলতে গিয়ে কবি, গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছিলেন নাচের আসরের নর্তকীর দেহের অস্থি-মজ্জার কথা। আমি বলবো প্রতিটি মানুষের শারীরিক গঠনের কথা। প্রত্যেক মানুষই হাঁটে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে। এ হাঁটা তার একান্তই নিজের। এ চলায়ও আছে তার নিজস্ব স্টেপ বা পদক্ষেপ এবং চলার নির্দিষ্ট দূরত্ব বা তাল। এ তাল- চলনই হলো একজন কবিতা লেখায় তার গদ্যরীতি। সুন্দর হাঁটা যেমন ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলে, সুন্দর গদ্যরীতিও তাই। আর চলতে চলতে যদি ক্লান্তি আসে হঠা-ই থেমে পড়তে হয়- তবে চলারও যেমন ছন্দপতন হয়, কবিতায়ও তেমনি। আসলে পাঠককে ধরে রাখাই গদ্যকবিতার মূল বৈশিষ্ট্য। পড়তে পড়তে পাঠক যাতে ক্লান্ত না হয় সেদিকে খেয়াল করলেই কবিতার গদ্যছন্দে আসবে কবির স্বার্থকতা।

১৩.০৬.২০০৬


**
ব্লগের পোস্ট দেখে আধুনিক কবিতা নিয়ে দু'কলম লেখার ইচ্ছে হয়েছিলো। কিন্তু সময়াভাবে আর নতুন লেখা হলো না। তাই এ লেখাটিই আবার পোস্ট দিলাম।

৮৯৪ বার পঠিত

 

 

টানা গদ্য কবিতা : সতত ডানায় এক জন্মান্ধজনের রসাতল যাত্রা

রাশেদুজ্জামান
এক.নাট্যকার মলিয়ের মজা করে বলেছিলেন, All that is not prose is verse; and all that is not verse is prose. মলিয়েরের যুগ হতে কয়েকশো বছর দূরে সরে এসে আজ দেখি, কবিতারই রয়েছে  সুনির্দিষ্ট পরিচয়-সংকট। কবিতা যে কী, কিংবা কোনটা যে কবিতা নয় তা বোঝা আরও দুরূহ হয়ে উঠেছে এতদিনে। কবিতার ধ্বনিসজ্জা ছন্দিত, ভাব-পরিবেশ ছোঁয়া-যায়-কি-যায়-না এমন, আর ভাষা নিত্যদিনকার নয়, উপমা-রূপক-প্রতীক-চিত্রকল্প দিয়ে সুরতি। http://poetrybangla.files.wordpress.com/2012/09/prose-poetry.jpg?w=450&h=338কোনো শক্তিশালী আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত উসারণ হচ্ছে কবিতা, এমন কথাও শোনা গিয়েছিলো। কিন্তু শ্রুতিমধুর এ উক্তি যে কবিতাকে চেনায় না, তা বলা চলে। হ্যামলেটের সংলাপে যত কাব্যিক মধুরতা থাকুক, ওটি তো কবিতা নয়, নাটকই। আর হেরমান হেসের সিদ্ধার্থও একটি উপন্যাস ; বা বাইবেলের ইংরেজি অনুবাদে যতই ক্যারিশমা থাকুক, সেটিও কবিতা নয়, ধর্মগ্রন্থ। তাহলে টানা গদ্য কবিতা বলে যে লেখাগুলোকে দাবি করা হচ্ছে, তা যে কবিতাই, কী প্রকারে নির্ধারিত হবে ? আসলে সুস্থির মানদণ্ডে বিচার অসম্ভব, কেননা মানদণ্ডের নিজেরই মান ত্রুটিপূর্ণ। এ সমস্ত প্রসঙ্গের অবতারণা এই কারণে যে, টানা গদ্য কবিতা আবির্ভূত হওয়ার দেড়শো বছরের বেশি পার হবার পর এই বঙ্গ ভূখণ্ডে দেখতে পাচ্ছি টানা গদ্য কবিতা রচনার হিড়িক পড়ে গেছে। বিষয়টি তরুণদের ক্ষেত্রে ত্রই, এবং ব্যাপক মাত্রায়। এর কারণ কি এই যে, কবিতায় ছন্দের প্রয়োজন অবান্তর হয়ে গেছে বলে তারা ভাবছেন ? কিংবা যে কবিতাগুলো তাদের হাত থেকে বেরুচ্ছে, তার জন্য টানা গদ্যই অপরিহার্য ফর্ম? বা, এভাবে কবিখ্যাতি আয়ত্ত করা বেশ স্বস্তিকর? ? বিষয়টি নিয়ে ভাবা এখন আমাদের খুব গুরুত্ববহ বলে মনে হচ্ছে। বাংলা কবিতার ভবিষ্য যাদের হাতে, সেই তরুণরা কি ছন্দহীনতার নতুন ঐতিহ্যবরণ করতে যাচ্ছেন ? সে তারা যা-ই করুন, কবিকে টিকতে কিন্তু হবে কবিতার জোরে, আর কবিতাকে শিল্পের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হবে।
দুই.
আমরা যাকে বর্তমানে টানা গদ্য কবিতা বলছি
, ইংরেজিতে তা Prose Poem নামে পারচিত। Prose Poem বলতে বোঝানো হয়ে থাকে এমন কবিতাকে যা বহন করে কবিতার সমস্ত গুণাবলী, যদিও দেখতে গদ্যের মতো। গদ্যাকারে সাজানো হলেও এর ভাষা কবিতার মতো সুললিত, অন্তর্লীন ছন্দপ্রবাহে গতিশীল, আবেগ সংক্রামক, কল্পনার জগতের, উপমা-চিত্রকল্পে আবৃত এবং এর অভিঘাত কবিতারই। আসলে টানা গদ্যের মাধ্যমে কবিতা তার প্রথাগত চেহারা থেকে সরে এসেছে। আধারের বিভিন্নতা ত্যাগ করে হয়ে উঠেছে আধেয়-নির্ভর।
প্রশ্ন জাগতে পারে গদ্য তো টেনেই লেখা হয়, তাহলে এই ফর্মটিকে টানা গদ্য কবিতা বলার কারণ কী ? আসলে ইংরেজিতে যাকে free verse বলে, বাংলায় তার নাম দেওয়া হয়েছে গদ্য কবিতা এবং এটি কিন্তু কবিতার প্রথাগত চেহারাতেই রচিত হয়েছে (free verse কে গদ্য কবিতা বলা সঙ্গত কিনা তা ভেবে দেখা উচিত। গদ্য শব্দটি উচ্চারিত হলেই আমাদের মনে গদ্যের আকৃতিটিও ভেসে ওঠে, এবং প্রকৃতিও, সেখানে কবিতার প্রচলিত ছন্দের কোনো জায়গা নেই। free verse কে গদ্য ছন্দ না বলে একে মুক্ত ছন্দ [মুক্তক নয়] বলা যেতে পারে, কেননা ছন্দের নিয়মিত পর্বভেদ এতে নেই ; কিন্তু তা সত্ত্বেও সূক্ষ্মভাবে ছন্দশাসন থাকে। দেখা যায় একটি ছন্দ-পর্ব আরেকটির মধ্যে এমনভাবে ঢুকে পড়ে যে সবসময় তাকে আলাদা করা যায় না, এবং তা সত্ত্বেও তার উপস্থিতি থাকে) । এর জন্য রবীন্দ্রনাথ কিংবা সমর সেনের  বা অন্য কোনো কবির গদ্য কবিতা স্মরণ করতে পারি। এই গদ্য কবিতাকে টেনে গদ্যের মতো সাজালে যে চেহারা পাওয়া যাবে, তা-ই টানা গদ্য কবিতা। এটা প্রচলিত মত। কিন্তু ছন্দে কবিতা লিখে যদি তা গদ্যের মতো করে সাজানো যায়, তাহলেও কি তা টানা গদ্য কবিতা নামে চিহ্নিত হবে ? হাল আমলে অনেককেই আমরা দেখছি গদ্যের মতো লিখলেও ভেতরে প্রথানুগ ছন্দ ব্যবহার করছেন। আমরা অবশ্য এখানে প্রচলিত পরিভাষাই ব্যবহার করবো।
তিন.
Writing free verse is like playing tennis with the net down, বলেছিলেন রবার্ট ফ্রস্ট। এই উক্তিটিকে ব্যজস্তুতি হিসেবে নিলে দাঁড়ায় : গদ্য কবিতা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ ; কেননা ছন্দ নেই কিন্তু তার অদৃশ্য উপস্থিতিকে (ছন্দতো খানিকটা চোখে দেখার ব্যপারও) অক্ষন্ন রাখতে হয়। এটি দক্ষ শিল্পীর কাজই বটে। পুনশ্চ কাব্যের ভূমিকাতে রবীন্দ্রনাথকে বলতে শুনি :

গদ্যকাব্যে অতি নিরূপিত ছন্দের বন্ধনকে ভাঙাই যথেষ্ট নয়, পদ্যকাব্যে ভাষার প্রকাশরীতিতে যে সলজ্জ অবগুণ্ঠনপ্রথা আছে তাও দূর করলে তবেই গদ্যের স্বাধীন ক্ষেত্রে তার সঞ্চরণ স্বাভাবিক হতে পারে। অসংকুচিত গদ্যরীতিতে কাব্যের অধিকারকে অনেকদূর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব এই আমার বিশ্বাস
বাংলায় গদ্য কবিতা রবীন্দ্রনাথ যখন লিখতে শুরু করেন তখন যে সমস্যাগুলো অতিক্রম করতে হবে ভেবেছিলেন, তা এখানে বলতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের হাতে পুনশ্চ কাব্যে গদ্যছন্দে যে কবিতা আমরা পেয়েছি, তা বাংলা টানা গদ্য কবিতার পথিকৃ অনেকটাই। অবশ্য লিপিকার ভূমিকাকেও ছোট করে দেখলে চলবে না।  আমাদের ধারণা : ছন্দমুক্তির একটি চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে এই টানা গদ্য কবিতা। মধুসূদনের হাতে যখন অমিত্রার ছন্দের আবির্ভাব হলো তখন সবচেয়ে বড় পদপেটি আসলে রচিত হয়ে গেল। এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তকের আবির্ভাব বলা যেতে পারে। সেখান থেকে গদ্য ছন্দে যাত্রা একটি বড়সর লম্ফ বটে। কিন্তু মনে রাখতে চাই গীতাঞ্জলির যে গানগুলি বিশ্বের শ্রদ্ধা-সম্ভ্রম আকর্ষণ করতে পেরেছিলো, সেসব আসলে ইংরেজি গদ্যে অনূদিত হয়েও পেরেছিলো। এটি রচয়িতাকে তো বটেই অন্যদেরও সাহস জুগিয়েছিলো বলতে হবে। বাংলা ভাষার প্রথম গদ্যছন্দে রচিত কবিতার কবি হচ্ছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। রবীন্দ্রনাথ, সমর সেন বা অন্য কারোর পদ্যঢঙে লেখা কবিতাকে (প্রথাগত কবিতার পঙক্তির মতো সাজানো কবিতাকে) যদি গদ্যের মতো সাজিয়ে দেই, তাহলে কি তা ব্যর্থ হয়ে যাবে ? আমাদের বিশ্বাস সব ক্ষেত্রে তা সফল হবে না। প্রথমে প্রেমেন্দ্র মিত্রের এই পঙ্ক্তি কটি  পাঠ করা যাক ওপরে তার টানা গদ্যের রূপটিও
১.(ক) সেইসব হারানো পথ আমাকে টানে;
         কেরমানের নোনা মরুর ওপর দিয়ে,
         খোরাশান থেকে বাদক্শান,
         পামিরের তুষার-পৃষ্ঠ ডিঙিয়ে, ইয়াকন্দ থেকে খোটান
         শ্রান্ত উটের পায়ে পায়ে যেখানে উড়েছে মরুর বালি,
         চমরীর ক্ষুরে লেগেছে বরফ-গলা কাদা
         বাদকশানের চুনি আর খোটানের নীলার নিষ্ঠুর ঝিলিক-দেওয়া,  
         ভেঙে-পড়া ক্যারাভানের কঙ্কালে আকীর্ণ,
         লুব্ধ বণিক আর দুরন্ত দুঃসাহসীর পথ
         লাদাকের কস্তুরীর গন্ধ যেখানে আজো লেগে আছে পুরানো স্মৃতির মতো
                                                                                         (পথ, সম্রাট)

১.(খ)   সেইসব হারানো পথ আমাকে টানে; —কেরমানের নোনা মরুর ওপর দিয়ে, খোরাশান থেকে বাদক্শান, পামিরের তুষার-পৃষ্ঠ ডিঙিয়ে, ইয়াকন্দ থেকে খোটান। শ্রান্ত উটের পায়ে পায়ে যেখানে উড়েছে মরুর বালি, চমরীর ক্ষুরে লেগেছে বরফ-গলা কাদা। বাদকশানের চুনি আর খোটানের নীলার নিষ্ঠুর ঝিলিক-দেওয়া, ভেঙে-পড়া ক্যারাভানের কঙ্কালে আকীর্ণ, লুব্ধ বণিক আর দুরন্ত দুঃসাহসীর পথজ্জলাদাকের কস্তুরীর গন্ধ যেখানে আজো লেগে আছে পুরানো স্মৃতির মতো।
আমাদের ধারণা এখানে ১.ক-তে যে উদাত্ততা আছে তা পরের অংশে অর্থা ১.খ-তে নেই। একইভাবে সমর সেনের কবিতাগুলিকে যদি গদ্যের মতো সাজানো যায়, তার ফলও নেতিবাচক হবে। টানা গদ্যে গতি চারিয়ে দেওয়া যায়, যেমন মান্নান সৈয়দ দিয়েছেন। যেখানে কবিতাটি আখ্যানকে সঙ্গী করেছে সেখানেও এটি সফল হতে পারে। জীবনানন্দের শিকার কবিতাটি নিয়ে এই নিরীক্ষা চালানো যেতে পারে। কিন্তু অন্ধকার কবিতাটির বেলায় এই প্রয়াস ব্যর্থ হতে বাধ্য। আবার, আখ্যান থাকলেও তা যদি উদাত্ত স্বভাবের হয়যেমন, রবীন্দ্রনাথেরই শিশুতীর্থতা সফল হবে না সম্ভবত। গদ্যের মধ্যে যে গড়িয়ে গড়িয়ে চলার প্রবণতা আছে, আছে পরের বাক্যটিকে স্পর্শ করার স্বভাব, সেটি তো পদ্যঢঙে নেই। পদ্যঢঙে যেটি আছে, সেটি আবার তার নিজস্বপঙক্তিগুলো দাঁড়িয়ে থাকে একাকী, বিচ্ছিন্ন ও শূন্যতার প্রতিস্পর্ধী হয়ে যেন। প্রচল চেহারার কবিতা হচ্ছে অনেকটা গাছের মতোযে মৃত্তিকায় জন্মালেও সোজা উঠে গিয়ে আলিঙ্গন করতে চায় মেঘলোককে ; আর অন্যদিকে টানা গদ্য কবিতার ধরন যেন লতা স্বভাবের, যার প্রকৃতি কোনো কিছুকে আকড়ে অগ্রসর হওয়া ; সে ছুঁতে চায় দিগন্তকে।

১৮০০ খ্রিস্টাব্দে জর্মন কবি নোভালিস প্রেমিকার মৃত্যুজনিত বিষাদকে রূপ দিলেন
Hymnen an die Nacht (1800; Hymns to the Night) গ্রন্থে। টানা গদ্যে লেখা এই ছয়টি কবিতার মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছে ছন্দিত পঙক্তিও। কবি হোল্ডার্লিনও লিখেছিলেন কিছু এমন কবিতা। এদেরই দিতে পারি প্রবর্তকের শিরোপা। ফরাসিদের মধ্যে প্রথম এ ধরনের কবিতা  লেখেন বার্ট্রান্ড লুইস। তার এধংঢ়ধফ ফব ষধ হঁরঃ Gaspard de la nuit (1842; “Gaspard of the Night”) নামের বইটির মাধ্যমে টানা গদ্য কবিতার সূত্রপাত হলো, যদিও এটি তার জীবদ্দশায় তেমন গুরুত্ব পায়নি (তিনি অবশ্য স্মরণীয় হয়ে ওঠেন প্রতীকবাদী আন্দোলনের আদি-গুরু হিসেবে)। কিন্তু তার মৃত্যুর পর শার্ল বোদলেয়ার, যিনি আধুনিকতাবাদী কবিতার জনয়িতা ও দণ্ডিত শহিদ, কবিতার ছন্দ-প্রশাসন ভাঙা এই নতুন ফর্মটিকে অমরতা দিলেন। Petite poèmes en prose নামের বইটি প্রকাশিত হলো তার মৃত্যুর পরে ১৮৬৯ সালে এবং পরে রচয়িতার ইচ্ছা অনুযায়ী, এর নাম দেওয়া হলো : Le Spleen de Paris (Abyev‡` The Parisian Prowler, 2nd ed., 1997).. এভাবে পাঠকের সামনে এলো এমন লেখা যেটি প্রচারিত কবিতা হিসেবে, কিন্তু তাতে নাই ছন্দের বালাই, উপরন্তু দেখতে গদ্যের মতো। ভাষার জায়গাতে এটিকে যে গদ্যের সাথে মেলানো যায় না, তা সবাই দেখতে পেলেন। বোদলেয়ারের টানা গদ্য কবিতা Be Drunk থেকে:
And if sometimes, on the steps of a place or the green grass of a ditch, in the mournful solitude of your room, you wake again, drunkenness already diminishing or gone, ask the wind, the wave, the star, the bird, the clock, everything that is flying, everything that is groaning,  everything that is rolling, everything that is singing, everything that is speaking…ask what time it is and wind, wave, star, bird, clock will answer you : “It is time to be drunk! So as not to be the martyred slaves of time, be drunk, be continually drunk! On wine, on poetry or on virtue as you wish.”

এরপর মালার্মের হাত থেকেও বেরিয়ে এসেছে বেশ কিছু টানা গদ্য কবিতা। ফরাসিদের এই ধরনের কবিতার ঐতিহ্য ভালোই আছে। কিন্তু ইংরেজিতে টানা গদ্য সম্ভব নয়, এমন ধারণাই চালু ছিলো দীর্ঘদিন ম্যথু আর্নল্ড এর প্রয়াস সত্ত্বেও। ষাট-সত্তরের দশকে এই ধারণা পাল্টে যায় আমেরিকানদের হাতেরবার্ট ব্লাই, এ্যালেন গিন্সবার্গ, চার্লস সিমিক, জেমস রাইট, রাসেল এডসন প্রমুখ কবির প্রয়াসে। আর আশির দশকে এটি গুরুত্ব পেতে শুরু করে ; বিভিন্ন সংকলনে ঠাঁই দেয়া হতে থাকে টানা গদ্য কবিতাকে। একক সংকলনও প্রকাশিত হতে থাকে। সারা বিশ্বেই এই ফর্মটি ছড়িয়েছে, গৃহীত ও অভ্যর্থিত হয়েছে। ¯প্যানিশ ভাষায় অক্টাবিও পাজও উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তার Eagle or Sun?? গ্রন্থে। একই ভাষার অপর দুই কবি এঞ্জেল ক্রেসপো ও গিয়ান্নিনা ব্রাশি করেছেন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ। দ্বিতীয়জন পাঠকের সামনে উপস্থিত করতে পেরেছেন টানা গদ্য কবিতার একটি ট্রিলজি, El imperio de los suenos (1988, Empire of Dreams)

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সময়ে গদ্য কবিতা রচনার হিড়িক পড়ে গিয়েছিলো
, আর তা দেখে যুগপ হতাশ ও বিরক্ত হয়ে, তিনি ওগুলোর নাম দিয়েছিলেন, ‘বাক-সর্বস্ব ভূতের বাসা’ ! কারণ তার বিবেচনায় কবি-প্রতিভার একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র ছন্দ-স্বাচ্ছন্দ্য। অবশ্য কেবল রবীন্দ্রনাথের গদ্য কবিতাগুলোকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন এই যুক্তিতে যে, রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘজীবনব্যাপী সাধনার প্রেক্ষিতে বিষয়টি স্বাভাবিক। বর্তমান বাংলাদেশে যেভাবে দুহাতে টানা গদ্য কবিতা লেখা হচ্ছে, তা দেখলে কেমন বোধ করতেন তিনি ? মনে হয় অত্যন্ত বিমর্ষ বোধ করতেন। তিনি নিজে ভেবেছিলেনএকসময় গদ্য ও পদ্যের কৃত্রিম ব্যবধান উঠে যাবে, আর তা অনিবার্য শিল্প পরিণতিএমন বিবেচনা থেকেই। বিখ্যাত প্রায় সব কবিই গদ্য ছন্দে লিখেছেন, হয়তো জাড্য কাটাতেও। টানা গদ্যে কবিতা লিখবার যে ঝোঁক তা এলো মূলত ষাটের দশকে। আর অত্যুতসাহ দেখা যাচ্ছে এই দশকে।  কিন্তু আমরা বাংলায় প্রথম টানা গদ্য কবিতা রচয়িতার মুকুট দেবো কাকে ? আমাদের বিশ্বাস এক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথই এর কৃতিত্বভাগী। তার লিপিকার  বেশ কিছু লেখা কোনো সন্দেহ ছাড়াই যে কবিতা, তা বলা যায়। আমরা এ বিষয়েও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মত গ্রহণ করতে পারি। তিনিও এগুলোকে বলেছিলেন গদ্যবেশী কাব্যপায়ে চলার পথ, প্রভাত ও রাত্রি ইত্যাদি লেখাগুলো, বলেছিলেন সুধীন্দ্রনাথ, ‘যে-মুহূর্তে চেচিয়ে পড়া যায়, তখনই এদের কাব্যরূপ ফুটে ওঠে।ওই রচনাগুলোতে তিনি ল করেছিলেন উপমার স্বপ্নময়তা, চিত্রময়তা। মালার্মের একনিষ্ঠ অনুসারী হলেও, তার মনে হয়তো মালার্মে রচিত টানা গদ্য বিষয়ে দ্বিধা ছিলো বা এই ফর্মটাকে তার ক্ল্যাসিক-মন পুরো গ্রহণ করে নি, তাই তিনি লিপিকার ওই লেখাগুলোকে অকুণ্ঠ ভাষায় কাব্য বলেন নি। ওগুলো যে কবিতা এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনের দ্বিধা পরে কেটে গিয়েছিলো । আমরা দেখি বুদ্ধদেব তার আধুনিক কবিতার সংকলনেও লিপিকার থেকে কবিতা অন্তর্ভুক্ত করছেন। পুনশ্চের ভূমিকা থেকে আবার উদ্ধৃত করি, রবীন্দ্রনাথ বলছেন :
ছাপবার সময় বাক্যগুলিকে পদ্যের মতো খণ্ডিত করা হয় নি, বোধ করি ভীরুতাই তার কারণ
 আজকের বিবেচনা থেকে বুঝি, ওগুলো আসলে টানা গদ্য কাবতা রবীন্দ্রনাথ টানা গদ্য কবিতার সচেতন স্রষ্টা নন, কিন্তু প্রথম স্রষ্টা এবং প্রতিভার অনন্যতা এখানেও অবারিত :
 এখানে নামল সন্ধ্যা সূর্যদেব, কোন্ দেশে, কোন্ সমুদ্রপারে, তোমার প্রভাত হল
 অন্ধকারে এখানে কেঁপে উঠছে রজনীগন্ধা, বাসরঘরের দ্বারের কাছে অবগুণ্ঠিতা নববধূর মতো ; কোন্খানে ফুটল ভোরবেলাকার কনকচাঁপা
 জাগল কে নিবিয়ে দিল সন্ধ্যায়-জ্বালানো দীপ, ফেলে দিল রাত্রে গাঁথা সেঁউতি ফুলের মালা
 এখানে একে একে দরজায় আগল পড়ল, সেখানে জানালা গেল খুলে এখানে নৌকো ঘাটে বাঁধা, মাঝি ঘুমিয়ে ; সেখানে পালে লেগেছে হাওয়া
ওরা পান্থশালা থেকে বেরিয়ে পড়েছে,
পূবের দিকে মুখ করে চলেছে; ওদের কপালে লেগেছে সকালের আলো, ওদের পারানির কড়ি এখনো ফুরোয় নি; ওদের জন্য পথের ধারের জানালায় জানালায় কালো চোখের করুণ কামনা অনিমেষ চেয়ে আছে; রাস্তা ওদের সামনে নিমন্ত্রণের রাঙা চিঠি খুলে ধরলে, বললে, “তোমাদের জন্যে সব প্রস্তুত
 ওদের হৃদপিণ্ডের রক্তের তালে তালে জয়ভেরী বেজে উঠল          
                                                                                                                                          (সন্ধ্যা ও প্রভাত, লিপিকা)

পরবর্তীকালের টানা গদ্য কবিতার মুখ্য বৈশিষ্ট্য এই কবিতাটির উদ্ধৃত অংশে আছে এবং চমকারিত্বও। কবির জিজ্ঞাসা, অনুযোগ কি বিস্ময়কে তিনি আড়াল করেছেন দাড়ি ব্যবহার করে। অন্যদিকে এর ভাষায় আছে গতিশীলতা। আবার ধ্বনির দিক যাচাই করলে দেখবো, এই লেখাতে সূভাবে অরবৃত্তের এবং কখনো মাত্রাবৃত্তের একটি অন্তঃসলিলা প্রবাহ বিদ্যমান। গদ্য কবিতাতেও একটি সুর থাকা চাই, যেটি লেখাটির ভাষাকে গদ্য থেকে পৃথক করবে। রবীন্দ্রনাথ এটি পেরেছেন।

ফরাসি কবিতার অনুরাগী ও রেবোর অনুবাদক কবি অরুণ মিত্র টানা গদ্যে আদ্যন্ত
একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করলেন, সের দিকে (১৯৫৪খ্রি.)। বাংলায় এটি টানা গদ্য কবিতার প্রথম একক বই। ফরাসি প্রতীকবাদের দ্বারা স্পৃষ্ট এর গদ্য-বিন্যাস।
ষাটের দশকের শেষের দিকে আবদুল মান্নান সৈয়দ যখন আদ্যন্ত-প্রায় টানা গদ্যে লেখা জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ প্রকাশ করলেন, তখন দারুণ হৈচৈ পড়ে গিয়েছিলো, জমে উঠেছিলো বিতর্ক। একে তো পরাবাস্তববাদের অভিনবত্বের চাপ (জীবনানন্দের কিছু উদাহরণ বাদ দিলে), অন্য দিকে ছন্দ অস্বীকার করে, কবিতার চেনা অবয়ব পাল্টে, গদ্যের মতো সাজিয়ে পাঠককে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দিলেন। এই বইয়ের আগেও টানা গদ্য বাংলাভাষী পাঠক লক্ষ করেছে শক্তি চট্টোপাধ্যায় (জরাসন্ধ) কি শঙ্খ ঘোষের (দিনগুলি রাতগুলি) দু-একটি রচনায় ও অরুণ মিত্রের সের দিকে গ্রন্থেকিন্তু এই বইয়ের মাধ্যমে বাংলাভাষায় টানা গদ্যের একটি বড় পদক্ষেপ আমরা দেখতে পেলাম। আবদুল মান্নান সৈয়দ তখন তরুণ এবং ওটি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এই বইয়ের টানা গদ্যের বিশিষ্টতা ছিলো :
১. জ্যোস্না ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে দরোজায়, সব দরোজায়, আমার চারিদিকে যতোগুলি দরোজা আছে সময়ের নীলিমার পাতালের ; জ্বলছে গাছসকল সবুজ মশাল; বাস একটি নক্ষত্র, পুলিশ একটি নক্ষত্র, দোকান একটি নক্ষত্র : আর সমস্তের উপর বরফ পড়ছেএরকম দৃশ্যে আমি অহত হয়ে শুয়ে আছি পথের উপর, আমার পাপের দুচোখ চাঁদ ও সূর্যের মতো অন্ধ হয়ে গেল, আর যে-আমার জন্ম হলো তোমাদের করতলে মনোজ সে অশোক সে : জ্যোস্না তার কাছে ভূত কিন্তু একটি গানের উপর, দরোজা তার কাছে পুলিশ কিন্তু একটি জন্মের উপর, মৃত্যু তার কাছে দোজখ কিন্তু একটি ফুলের উপর
(
অশোককানন, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ)
 
২. এই রাত্রিরা বেথেলহাম-কে ব্রথেলে পরিণত করে,
করুণ কবাটের মতো ঝোলানো বাড়ির দেয়াল থেকে লুটিয়ে থাকে যেন বর্ম কিংবা বিরুদ্ধ পদ্ধতি হাওয়াররূপালি চাবির অভাবে এই রাত্রিরা সেই লাল আলোর ভালো যা তোমাকে প্রশস্ত স্ট্রীট থেকে নিয়ে যাবে কঙ্কালের সরু-সরু পথে, অনাব্য স্ত্রীর মতো কেবলি অন্যদিকে;—যখন জানালায় ছিন্নপত্র ঝরে অবিচ্ছিন্ন, লোকালোক পুড়ে যায় বরফে এই রাত্রিরা জিরাফের গলা বেয়ে লতিয়ে উঠতে দেয় আগুন, যেটা আমাদের আকাক্সা, অবশ্য যদি তার মাংস হতে রাজি হই তুমি আর আমি ; ঈশ্বর নামক গৃহপালিত মিস্তিরি ভুল সিঁড়ি বানাচ্ছে আমাদের উঠোনে বসেআগুনের, যে-অসম্ভবের সিঁড়িতে উঠতে-উঠতে আমরা সবাই পাতালে নেমে যাবো হঠা
 সিংহের খাঁচায় বসে আমি গল্প লিখছি মনে-মনে
                                                        (পাগল এই রাত্রিরা, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ)

চিন্তার অভিনবত্বের সাথে ভাষায় যে ঘোর তৈরি করেছেন এখানে কবি, তা পঠককে লেখাটি পুনর্পঠনে প্ররোচিত করে। পরাবাস্তবতার অচেনা মহলে প্রবেশ করিয়ে দ্রুত এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে যেতে যেতে কবি অর্থ-উদ্ধারের আকাক্সাকে যেন ভুলিয়ে দেন। কবিতাগুলো, প্রচলিত ব্যাকরণকে পাশ কাটিয়ে অনাব্য স্ত্রীর মতো কেবলি অন্যদিকে যেতে প্ররোচিত করে,   যেহেতু লোকালোক পুড়ে যেতে থাকে বরফে। সিংহের খাঁচায় বসে লেখা এইসব গল্পের ভাষা বেশ দ্রুতগতির। তার টানা গদ্যের কবিতার বৈশিষ্ট্য মূলত এরকমই । অবশ্য বেশ প্রসন্ন ও মন্থর ভঙ্গির লেখাও তার আছে। পাঠকের মনে পড়বে, একই কাব্যগ্রন্থের পরস্পর কবিতাটি। টানাগদ্যে আখ্যান বা কাহিনি ব্যবহার করার চেষ্টা তার পরের দিকের দুএকটি কবিতায় ল করি। অবশ্য কবিতাগুলিকে সফল বলা যাবে না।
এর পরে ষাটের দশকের আরেক তরুণ সিকদার আমিনুল হক সত্তুরের দশকে বের করলেন তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ দূরের কার্নিশ, যার অর্ধেক জুড়ে আছে এই টানা গদ্য। বাংলাভাষায় টানা গদ্যের তিনিই সম্ভবত সবচেয়ে একনিষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠতম শিল্পী। আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রথম বইয়ের পর দ্বিতীয় বইতে (জ্যোস্না ও রৌদ্রের চিকিসা) কিছু টানা গদ্যের কবিতা লক্ষ করি; এবং পরে কবি এ থেকে আরও সরে আসেন। অন্যদিকে সিকদার আমিনুল হক প্রথম বইয়ের পর টানা গদ্য কবিতা লেখেন নি দীর্ঘকাল। নয়ের দশকে এসে পরিণত মনন নিয়ে প্রকাশ করলেন আদ্যন্ত টানা গদ্য কবিতার বই সতত ডানার মানুষ। সম্ভবত এটিই বাংলাভাষার প্রথম টানা গদ্য কবিতার বই (জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ-এ ছন্দে লেখা দুটো কবিতা রয়েছে।)। এর আরও পরে এলো তার একই ধারার আরও একটি কাব্যগ্রন্থ বাতাসের সঙ্গে আলাপ। আমরা জানি আকস্মিক মৃত্যু কবিকে ছিনিয়ে না নিলে তিনি টানা গদ্য কবিতার একটি ট্রিলজি পুরো করতেন, যা শেষ হতো আদ্যন্ত টানা গদ্যের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ দূরের কার্নিশ থেকে এবার পাঠ করা যাক :
আমাকে শিখতে হয়েছে সব একা,
নবজাতকের মতো ঘ্রাণের মধ্যে আমি ঝড়ো হাওয়ার চিহ্ন পাই অশ্রুত পথের পাশে দাড়িয়ে মৌমাছির মতো বলতে পারি সোজাসুজি ফুলেদের নাম তবু সে বালক কোনো সম্মান পায় নি!
 এখন বিষয়বস্তুর মধ্যে তাই জল বার বার ফিরে আসে সমুদ্র থেকে ফিরে এলে নাবিকের স্বপ্নের ভিতরে যেমন ফিরে আসে হাঙরের ঝাঁঝালো জিহ্বা, অথবা হৃতবস্ত্র নারীর জঙ্ঘার উপরে বারবার ফিরে আসে যেমন ধর্ষণের বাতাস!….
 অহঙ্কারের শেষ হয়েছে আমি তাই জলের মধ্যে বার বার ফিরে আসি এই ভাবে জন্ম নেয় সমুদ্র আর্দ্র নির্লজ্জ নারীর হাতে সমুদ্রের আক্রমণ যা প্রতি প্রত্যূষে আমার রক্তকে রঞ্জিত করে
 আমাদের জন্ম-জন্মান্তর জলের মধ্যে সেই বিশাল পদচিহ্নের ইতিহাস আমাদের ওষ্ঠদেশ সেই লবণচিহ্ন থেকে এখনো পরিত্রাণ পায়নি…..
  (বৃত্তান্ত, দূরের কার্নিশ )

গতির দ্রুততা ও চিত্রের উল্লম্ফন সিকদার আমিনুল হকের বৈশিষ্ট্য নয়। এক প্রসন্ন বিহ্বলতা যেন তাকে বলতে প্ররোচিত করে। কবিতায় তার ভাষা মৃদু, শান্ত, অচঞ্চল, সাবলীল, ও পরিকল্পিত। এক অনুচ্চ অন্তর্লীন ও দূরাভিসারী সঙ্গীতের প্রবাহ একে ঘিরে আছে। বিষয়কে প্রতীকায়িত করে এক প্রলুব্ধকর অস্পষ্টতা তৈরির প্রবণতা এই বইয়ের কবিতায় আমরা পাবো। কিন্তু সিকদারের আত্মমুদ্রাও এখানে অঙ্কিত হয়ে গেছে। শিল্প-তীর্থের উদ্দেশে এক আভিযাত্রা বা সেই অভিযাত্রার বয়ান এই কাব্য, যা অঙ্গীভূত করে নিয়েছে জীবন কিংবা নারীর শিল্প-সারার্থ উন্মোচনের দায়অস্পষ্ট করে হলেওমানুষের প্রতি অঙ্গীকার। এবার পাঠ করতে পারি এই অংশটি :
মানুষকে কোনো কথাই বলা হয়নি, তবু সে জেনে নিয়েছে পাথরের ভাষা ওজন করতে শিখেছে ব্রোঞ্জ আর নিরাবরণ নারীর বিশালতাঝাঁঝালো রূপসীর পশ্চাদেশের বিশালতা কোনো সমুদ্রও নয়, তবুও সেখানে নোঙরের জন্য চঞ্চল ইচ্ছাই শব্দগুচ্ছের মর্যাদা পায়না হয় নারী, তোমাকেই, শেষবার অভিবাদন জানাবো
(
পদদলিত শিরস্ত্রাণ, দূরের কার্ণিশ)
পরবর্তী সকল কাব্যে, বিশেষত টানা গদ্যের কাব্য দুটিতে নারীর প্রতি অভিবাদন রচিত হয়েছে অকুণ্ঠ ভাষায়। নারী নামক বন্দরে নোঙরের আর্তিই এর অন্যতম মুখ্য প্রবণতা। দূরের কার্নিশে প্রতীকায়িত জলও পরবর্তীকালে ফিরে এসেছে বার বার কিন্তু অন্যরূপে। তার মৃত্যুর পরে আজ আমি আমরণ সমুদ্রের দিকে যাবোএই প্রত্যয়ী উচ্চারণের গভীরতা আমরা অনুভব করতে পারি। সিকদার আমিনুল হকের টানা গদ্যের বিশিষ্টতা ও বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করতে গেলে আমাদের তার পরবর্তী কাব্য দুটি, সতত ডানার মানুষ ও বাতাসের সঙ্গে আলাপ পাঠ করতে হবে অভিনিবেশের সাথে, যেখানে কবি হয়ে উঠেছেন আরও অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ ও ল্যভেদী। কবি হয়ে উঠেছেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এটি আসলে তার কাব্যের একটি স্বতন্ত্র পর্ব। সতত ডানার মানুষ  থেকে উদ্ধৃত করা যাক :
১.    ….আজ আমি প্রসঙ্গত নারীর কথাই বলবোআমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে; এখন আমি মানুষের লালসা নিয়েও ঠাট্টা করতে পারি বয়স হলো সেই উট, বালুর অন্ধকার ঝড়ের মধ্যেও যে তার মালিকের পাগড়ির রঙ ঠিকঠিক চিনতে পারে; অথচ উটকে দেখতে পায় না কেউ
 
২.   
মৃত্যু সেই পরিচিত তরবারি, যা আমাদের হাত থেকে স্বজনেরা নেয়ার মুহূর্তেও আমরা যার ধারালো যন্ত্রণার কথা বিস্মৃত হয়ে আকাশ কিংবা জরির মতো কাজ করা মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকিএবং তার ছায়া ও ভীতি অপসৃত হওয়ার আগেই রূপসী নারীর সঙ্গম স্পৃহার দিকে শরীরে জন্তুর গন্ধ নিয়ে এগিয়ে যাই
 
৩.   
শেষ কথা স্বৈরশাসক আর দুর্ধর্ষ বর্বর বিজয়ী সম্রাটের মুখেই মানায়; যাঁদের দম্ভ আর শক্তির একটি করুণ ডানা মৃত পতঙ্গের মতো সমুদ্রের বালির ওপর অতি নির্বাসনে পড়ে থাকে
ওপরের তিনটি উদ্ধৃতিতেই একটি বিশেষ কৌশলযা তার বৈশিষ্ট্যচোখে পড়ে আমাদের। সেটি হচ্ছে, কবি যখন উপমার প্রয়োগ করেন তখন সেটিকে প্রসঙ্গ ছাড়িয়ে আরও দূর পর্যন্ত প্রসারিত করে দিতে চান। উপমার জন্য তিনি নিতে পছন্দ করেন সাধারণত কোনো বস্তু  বা বিষয় নয়, বস্তু বা বিষয়ের ধারণা ও তার পরিপার্শ্ব। আবার বস্তুকে গ্রহণ করলেও দেখা যাবে নিচ্ছেন ওই বস্তুটির কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রাপ্ত অবস্থা। ফলে সেটি হয় একটি পুরো বাক্য। উপমা-চিত্রকল্প কি বর্ণনার ক্ষেত্রে পাঠকের অভ্যস্ততা যেখানে থামতে চায়, তিনি সেখানে শ্বাস ফেলেন মাত্র, কিন্তু চলে যান আরও দূরে, পাঠকের ভাবনা কে ছাড়িয়েপ্রসঙ্গকে বিশদ করে তোলেন। প্রথম উদ্ধৃতিতে বয়সকে তিনি তুলনা করলেন উটের সাথে, যে উট মরু ঝড়েও মালিককে চিনতে ভুল করে না। এখানেই পাঠকের প্রত্যাশা সমাপ্ত। কিন্তু তিনি এখানে না থেমে এগিয়ে গেলেন আরও। ফলে উপমাটি বক্তব্যকে জোরালো করেই সমাপ্ত হয় নি, বক্তব্য-বিষয়ের অংশ হয়ে গেছে। তার বাগভঙ্গি এখানে খুবই উন্মেচন-প্রিয়। তার এই কবিতাগুলো আসলে নারীকে সামনে রেখে নিজেরই উন্মোচন যেন ; যা-কিছুরই উন্মোচন তিনি করুন না কেন। ফলে তার উচ্চারণগুলো অনিবার্য সত্যের মহত্ত্ব পেয়ে যায়। কোথাও কোথাও রচনা করে ফেলেন আপ্তবাক্য। কিংবা দেখতে পাই কখনো স্থির ও নিশ্চয়াত্মক ধর্মগ্রন্থীয় বাকপ্রতিমার অনুকরণ, যেন সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে থেকে এক দেবপ্রতিম কবিসত্তা অমোঘ উচ্চারণের প্রয়স করছে। অনিশ্চয়তার কম্পন যা সহজে সংক্রামক, তা তাকে আলোড়িত করে কম। বিস্ময়ের অধ্যায় যেন অবসিত। জীবন সম্পর্কিত প্রশান্ত দার্শনিকতা এই গদ্যের অঙ্গীভূত ; এবং এই সেই শক্তি, যার ফলে চেনা হলেও তার ভাষাকে এতো আলাদা স্বাদের মনে হয়। টানা গদ্য কবিতার চাল এমন হওয়া উচিত বলে কি তিনি মনে করতেন? এবং এ জন্যই তরুণদের টানা গদ্য না লিখবার পরামর্শ দিয়েছিলেন?
পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ বাতাসের সঙ্গে আলাপে দেখতে পাচ্ছি টানা গদ্যে আরও কিছু কৃ-কৌশল তিনি ব্যবহার করছেন। কোথাও কোথাও টুকরো আখ্যান তিনি ব্যবহার করছেন ; আগের টানা গদ্যে যা-ছিলো আরও ফ্র্যাগমেন্টেডতবে কবিতার ভেতরে বিশেষভাবে আখ্যান বা গল্প ব্যবহার তার অভিপ্রেত নয়; অনেকগুলো কৌশলের এটি একটি মাত্র। যেহেতু অনেকটা কনফেশনাল ধরনে তিনি কথা বলেন, বিশেষত এই কবিতাগুলোতে সেহেতু আত্মজীবনীর নানান বিচূর্ণ অংশ বিভিন্ন মুখোশে প্রবেশ করেছে। নিচের টানা গদ্য কবিতাটি পড়া যাক :
একটা ঘোড়ার গাড়ি যাচ্ছিলো শাদা তুষারে ঢাকা পিটার্সবুর্গের রাস্তাঘাটের ব্যবহার তখন কম রাত্রি ছিলো আলোকিত ক টেবিলে জ্বলে যাচ্ছে মোমের বাতি
 এই স্বপ্নটা আমি একদিন নয়, দু-দিন নয়, তিনদিন দেখলাম
 গাড়ি যাচ্ছে ঘণ্টা বাজছে গাড়িওয়ালার হাতে ভেতরে জিভাগো ছিলেন না। (উপন্যাস কার প্রতিবিম্ব?) ছিলেন পাস্তেরনাক নিজে কবি লেখক মৃত্যু ভয়ে চিন্তিত প্রেমিক এবং যাঁর পশমের ওভার কোটের ভেতরে লুকানো থাকতো বাচ্চাদের কান্না !
 চতুর্থ দিন আবিষ্কার করলাম, স্বপ্নটা আর কিছুই নয় একটা ক্রোধ সেই ক্রোধটা হলো আমি আরও একবার এক মৌলিক দীর্ঘাঙ্গীর প্রেমে পড়েছি
                                                              (নতুন প্রেম, বাতাসের সঙ্গে আলাপ)
 
আমরা লক্ষ করলে পাবো
, এখানে কবি একটি আখ্যান ব্যবহার করছেন। এবং অন্যদিকে এর বাক্যগুলো বেশ হ্রস্ব। পাঠকের দ্রুত মনে পড়বে তার ছন্দে লেখা কবিতাগুলো, যেখানে হ্রস্ব বাক্যে এগোনোর কৌশল তার। আসলে এটা ঠিক আখ্যান বর্ণনা নয়, সিকদার তা চানও না। তিনি আখ্যানের প্রসঙ্গ থেকে পৌঁছুতে চান অন্য কোনো ডাইমেনশনে। যেমন, উদ্ধৃত কবিতাটির শেষে যে অভিনবত্বের চমক আমরা পাই, তা মহ শিল্পের অন্তর্গত। ডাক্তার জিভাগো উপন্যাসের আবহকে স্বপ্নের অনুসঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করে তিনি ঔপন্যাসিক ও তার সৃষ্ট চরিত্রকে এক সমান্তরালে এনে যে চমকারিত্ব ও ছক তৈরি করলেন এতণ, পরমুহূর্তে তাকে নিয়ে গেলেন অভাবনীয় এক উচ্চতায়। এমনিভাবে আমাদের মনে পড়তে পারে, গালিব স্ট্রিটে কবিতাটি, যেখানে কলকাতার গালিব স্ট্রিটে টানা-রিকশার আরোহী এক এংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ের ঘরে ফেরার ঘটনাই হয়ে উঠেছে রহস্যায়িত। পেছনের পট তৈরি করে দিয়েছে জ্যোস্না, আকাশে এক গোলাকার বোকা চাঁদ ভাসিয়ে দিচ্ছে সব। আমরা দেখি তখন, মেয়েটির আত্মীয়স্বজনেরা ক্রমেই দূর-দূরান্তের দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে যায়, আর বর্তমানকালে অতীতের অধিক্রমণ শুরু হয়ে যায়
 
এই হ্রস্ব কালো স্কার্ট,
এই বিষন্নতা, এই পূর্ণচাঁদ আর ধূমপানের কান্তি গালিব স্ট্রিটটাকে সোজা তুলে নিয়ে গেলো হারুনুর রশীদের বাগদাদে!
এভাবে ঘোর ও রাহসিকতা তৈরি করা তার একটি কৌশল বটে। সবক্ষেত্রে যে তিনি এটি করেন এমন নয়। সে যাক, তাকে নিয়ে একটি অভিযোগ চালু আছে। তিনি কবিতায় বিদেশী আবহ আনেন। আসলে সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় তার পঠন-অভিজ্ঞতার ছাপ আছে। আমার মনে হয় তা ইতিবাচক অর্থেই। তিনি তার প্রিয় সব কবি কি লেখককে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তাদের যাতনা-যাপিত জীবন কি দর্শনকে কবিতায় তাদের প্রতি স থেকে নানানভাবে এনেছেন। সম্ভবত তিনিই বিভিন্ন লেখক-শিল্পীকে নিয়ে সর্বাধিক কবিতা লিখেছেন। অন্যদিকে, যে শ্রেণীর জীবন তার লেখার প্রধান উপজীব্য, তার সঙ্গে  বিদেশী আবহের বিষয়টি মানিয়ে যায়। অবশ্য অনুসঙ্গ ধরে ধরে দেখলেও বিদেশী আবহের সত্যতা মিলবে। কিন্তু এ-ও আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে, সিকদার আমিনুল হক যে কৌশলে তার বাক্যগুলো নির্মাণ করেন ও বিন্যস্ত করেন, ওই ধারণার পেছনে তারও হাত কম নয়। তার বাক্যগুলো সাধারণত ইংরেজি কমপ্লেক্স বাক্যের আদলে নির্মিত। এতে থাকে যে, যার, যা, যেই-সেই ইত্যাদি সর্বনামের সুপ্রচুর ব্যবহার। কখনো দেখি তিনি এসব বাক্যের অধীন উপবাক্যটিকে আলাদা একটি বাক্যের মর্যাদা দিয়ে শুরু করছেন, যা শুরুই হচ্ছে ওই সর্বনামগুলো দিয়ে। কিংবা দেখা গেল একটা বাক্য শুরু হচ্ছে এবং-জাতীয় কোনো অব্যয় দিয়ে। কবিতার অপরিহার্য অঙ্গ উপমা-চিত্রকল্প-প্রতীক ব্যবহারের বিশেষত্বের কথা তো আগেই উল্লেখ করেছি। এছাড়া বিশেষণ ব্যবহারের কৌশলে তার অভিনবত্ব বা মৌলিকতা আমাদের যে বিস্ময়ের মধ্যে ফ্যালে তাতে আমরা অভ্যস্ত নই। এই বিশেষত্ব সম্বন্ধপদ ব্যবহার পর্যন্ত প্রসারিত। রবীন্দ্রনাথ যখন তার একটি গানে (সখি ভাবনা কাহারে বলে) লিখলেন, বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল তখন, পুরো গান বা কবিতাটিতেই জ্যোস্না প্লাবিত হলো, কুসুম যেন আরও কোমল হয়ে উঠলো প্রথাগত বিশেষণ ব্যবহার সত্ত্বেও ; এবং বাংলাভাষায় বিশেষণ প্রয়োগের এক নতুন অধ্যায় সূচিত হলো। শব্দের প্রতি তার সজাগদৃষ্টি পাঠক তাকে পাঠ করা মাত্রই পাবেন। কবির অহঙ্কারী বচন উদ্ধৃত করি এবার (অবশ্য তিনি কখনোই বিনীত বা নম্র নন, বরং দৃপ্ত ও সজাগ) :
সব শব্দের জয় , গন্ধ আর মতার চিত্র আমি জানি ভ্রমণের হাল্কা চোখ নিয়ে আমি আসিনি আমার চোখ প্রাচ্য দেশের এর ঠাণ্ডা গভীরতা সেই রুমালের মতো ; বাক্স খুললেই যার গুমোট গন্ধ আর পরিণত ভাঁজ ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়বে
                                                (যে-সব শব্দ আমি জানি, বাতাসের সঙ্গে আলাপ)

সিকদার আমিনুল হকের দুটি ইন্দ্রিয়ের তীব্রতা পাঠকের অনুভবকে এড়াবে না। তা হচ্ছে, দৃষ্টি ও শ্রুতি।
টানা গদ্য কবিতার আরেকটি চমকার বইয়ের খোঁজ পাঠকের মনোযোগের সামনে নিবেদিত হয়েছে এর পরে ; এটি গৌতম বসুর রসাতল। সান্দ্র মন্থরতার ভেতরে ভেতরে এক অনির্দেশ্য উদ্বেগ ও আর্তি অনুপ্রবেশ করে তার কবিতায়, দেখা দেয় চঞ্চলতা। উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে :
হারিয়ে যাওয়ার কথা, পৃষ্ঠাগুলি হারিয়ে, নষ্ট হয়ে যাওয়ারই কথা ; যেভাবে পাহাড়ের কোল থেকে বিশল্যকরণী চিরতরে হারিয়ে গেছে অশ্রুময়ী নামটি প্রখর তাপে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে যেইভাবে তার কাছে গিয়ে বসতে তাই আর মন সরে না ; দূর থেকে দেখি, দালান থেকে রোদ ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে, আমাদের বেঞ্চির উপরে একটা জলের কেটলি, হাতপাখা একটা, আর ফিরে-ফিরে আসছে বাস্পের চেয়েও সূক্ষ্ম ভগ্ন সেই পঙ্ক্তিমালা, সেই প্রজ্জ্বলিত উক্তির অবশেষ
 দিব্যোন্মাদ বাক্যসকল, জাগো বলো, আমরা হেঁটে এসেছি ধ্বংসের দিকে বেঁকে যাওয়া তমসাবৃত পথটিতে, ফিরে এসেছি, নির্মল ও সর্বশান্ত হয়ে ফিরে এসেছি
(
রক্ষা, রসাতল)
সময় ও অনুভূতির শূন্য পরিসরের দিকে তাকিয়ে এই উচ্চারণ। এর গদ্যের মধ্যে
আমরা একইসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের লিপিকা ও বিচিত্র প্রবন্ধের দূরাগত সুর টের পাই, মনে জাগতে চায় শিশুতীর্থের বাগভঙ্গিও। কিন্তু যেহেতু মোহিত হতে সমস্যা হয় না, বোঝা যায় কবির নিজস্বতা মুদ্রিত আছে দৃষ্টিভঙ্গিতে ও গদ্যের নির্মিতিতে।

এ ছাড়া সমসময়ের অনেক কবিই টানা গদ্য কবিতায় আত্মস্বার মুদ্রিত করতে
পেরেছেন, হয়তো একক কোনো গ্রন্থ লেখেন নি। এ ক্ষেত্রে  উপল কুমার বসুর নাম আসবে টানা গদ্যের কাঠামোতে ছন্দের চাল ভরে দেবার জন্য। দেখা যাবে একটি বাক্য ঢুকে যাচ্ছে পরবর্তী বাক্যে, পরের বাক্যটির কাঠামো চুরমার করে সেটি থামছে। একটি বড়সর কবিতা একটিমাত্র দাড়িতে শেষ হচ্ছে। কবিতায় ম্যাডনেস ঢুকিয়ে দেবার প্রয়াস যেন।
এর সাথে সাথে কবি রণজি
দাশের কথা বলা প্রয়োজন। তার টানা গদ্য কবিতাতে নিজস্বতা মুদ্রিত হতে পেরেছে যখন তিনি আখ্যানকে ব্যবহার করেন। একটা সামান্য প্রসঙ্গেও অসীমের ব্যঞ্জনা ও ব্যাপ্তি আনাই তার ধরন। অনেক সময় দেখি কবিতা নেহা প্রবন্ধের ভঙ্গিতে শুরু হচ্ছে, কিংবা একটি আখ্যানকে বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে অনুসরণ করতে করতে এগুচ্ছে, কিন্তু হঠা পাঠককে চমকে দিয়ে বুদ্ধিকে পার হয়ে এটি এমন জায়গাতে উপনীত হয় যেখানে ছোঁয়া লাগে অসামান্যের।
সাম্প্রতিক কালে টানা গদ্য কবিতা বিশ্ব জুড়েই একটি জনপ্রিয় মাধ্যম
, বাংলাদেশেও। নবীন-প্রবীণ নির্বিশেষে এখন বেদম লেখা হচ্ছে। এক্ষেত্রে  নবীনদের সাবধান হওয়া ভালো। কেননা যে ছন্দ-দতা বাঞ্ছনীয়, তার অভাবে তাদের টানা গদ্যের অভিযান ব্যর্থ হবে ; মেরুর দেখা পাবার বহু আগেই মরু-ঝড়ে নাহলে তুষার পাতে নিহত হবে কবিতা। শিল্প-সফল কবিতার কৃ-কৌশল আয়ত্ত করার আগে, ছন্দে পারঙ্গমতা আসার আগে এর চেষ্টা না-করা ভালো। রবার্ট ফ্রস্টকে আবার স্মরণ করিনেট ছাড়া টেনিস তো কোনো টেনিসই নয়, কিন্তু যে টেনিসে মাস্টার সে-ই নেট ছাড়া টেনিস খেলবার সাহস দেখাতে পারে। সিকদার আমিনুল হক সম্ভবত এজন্যই বয়স চল্লিশের আগে টানা গদ্য কবিতা লিখতে নিষেধ করেছেন।



random header image

লিখেছেন: হাসানআল আব্দুল্লাহ বিভাগ: আবৃত্তি, কবিতা, শিক্ষা, সাহিত্য আলোচনা তারিখ: ১৯ ভাদ্র ১৪১৭ (সেপ্টেম্বর ৩, ২০১০)
হাসানআল আব্দুল্লাহ
কবিতার উকৃষ্টতার জন্যে ছন্দ একমাত্র উপজিব্য না হলেও এটি যে প্রধানতম একটি দিক তা অস্বীকার করার উপায় নেই। শিল্প সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম, কবিতা, সৃষ্টির আদিযুগ থেকেই তাল লয় সুর ইত্যাদির সংমিশ্রণে ভাষার মালা হয়ে মানুষের মনে দোলা দিয়ে আসছে। অক্ষর ও শব্দের নানামুখি চালে এই মালা তৈরীর প্রক্রিয়া বা নিয়মই আদতে ছন্দ।
কালের বিবর্তনে, অতিক্রান্ত সময়ের সদ্ধিক্ষণে উকৃষ্ট কবিতা নির্মাণের জন্য বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে প্রায় সব ভাষার বিশিষ্ট কবিরা তৈরি করেছেন সুনির্দিষ্ট ও সুবিন্যস্ত নিয়ম। বাংলা কবিতাকেও অন্যান্য ভাষায় রচিত কবিতার মতো বাঁধা হয়েছে ছন্দের শৃঙ্খলে। আর এক পর্যায়ে ভেঙেও দেয়া হয়েছে সেই শৃঙ্খল, কিন্তু ভাঙার সেই প্রক্রিয়াও তৈরী করেছে নতুন ধ্বনি মাধুর্য।
ইট তৈরির কথা দিয়েই শুরু করা যাক। প্রথমেই প্রয়োজন উকৃষ্ট মাটির। মাটিকে আবর্জনা মুক্ত করে স্বচ্ছ পানি মিশিয়ে হাত দিয়ে বা মেশিনের সাহায্যে বারবার নেড়ে চেড়ে নরম করার প্রয়োজন পড়ে। তারপর এই মাটিকে ফর্মার মধ্যে ফেলা হয়। ফর্মায় মাটি ঠিক মতো পুরতে পারলেই মাটি আর মাটি থাকে না, ইটে পরিণত হয়। এখানেই শেষ নয়, এই নরম ইটকে শক্ত করার জন্য উচ্চ তাপে দগ্ধ করা হয়। লক্ষণীয় যে, নরম মাটিকে হাত দিয়ে পিটিয়ে বা মেশিনে নেড়ে চেড়েই ইটের রূপ দেয়া যায় না। দরকার একটি ফর্মা যা কিনা মাটিকে সুন্দর একটি ইটের আকার দিতে পারে।
কবিতার প্রসঙ্গেও একই রকম ভাবে বলা যায়, প্রথমেই প্রয়োজন সুন্দর একটা বিষয়। যদিও যে কোনো বিষয়েই উকৃষ্ট কবিতা তৈরীর প্রমাণ যথেষ্ট রয়েছে, তথাপি কবিতা লেখার শুরুর দিকে বা তরুণ কবিদের ক্ষেত্রে বিষয়ের গুরুত্ব অবহেলা করা যায় না। বিষয় স্পষ্ট হলে, তাকে ভাষায় রূপ দেয়ার জন্য দরকার শব্দ। বিষয় ও শব্দের একত্র মেলবন্ধনে গঠিত হয় কবিতার ভাব, যা ইট তৈরির পূর্বের ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করে। এখন প্রয়োজন ফর্মার। কবিতার ক্ষেত্রে এই ফর্মাই হলো ছন্দ। বিষয় এবং শব্দকে যদি নির্দিষ্ট ছন্দের মধ্যে গ্রন্থিত করা যায় তবে অন্তত দগ্ধ করার আগে কাঁচা ইটের মতো মোটামুটি একটা কবিতা দাঁড়িয়ে যায়। তারপর একে পরিপক্ক করার জন্য প্রয়োজন হয় উপমা, অনুপ্রাস, চিত্রকল্প ইত্যাদির। তাই, প্রথমে অন্তত সাধারণ ভাবে একটা কবিতা দাঁড় করার জন্য ছন্দের প্রয়োজনীয় দিকের প্রতি দৃষ্টি দেয়া যাক।
ছন্দের ভেতরে প্রবেশের আগে জানা দরকার শব্দের শরীর। আবার শব্দের শরীর সম্পর্কে জানতে হলে সর্বাগ্রে জানা দরকার স্বর বা ধ্বনি। স্বর জানার পর শব্দের শরীর অনেকাংশে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বাংলা স্বর বা ধ্বনিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
১. বদ্ধস্বর
২. মুক্তস্বর
বদ্ধস্বর:
যে সব ধ্বনি উচ্চারণের সময় জিভ মুখের প্রবহমান বাতাসকে আটকে দেয় তাদের বদ্ধস্বর বলা হয়। যেমন : কর, ধর, হায়, পাক, আঁক, ঝাঁক, থাক, দিন, বীন, হই, ইত্যাদি।
মুক্তস্বর:
যে সব ধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখের প্রবহমান বাতাস জিভের কোনো বাধা ছাড়াই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে তাদের মুক্তস্বর বলে। যেমন: হা, না, কা, চা, দি, দা, বা, বু ইত্যাদি।
এবার শব্দের শরীর প্রসঙ্গে আলোচনায় ঢোকার শুরুতেই বেছে নেয়া যাক করলামশব্দটিকে। স্পষ্টত এটি দুটি স্বর দিয়ে গঠিত। প্রথমটি করএবং দ্বিতীয়টিলামউপরে প্রদত্ত বদ্ধ এবং মুক্ত স্বরের সংজ্ঞানুসারে করএবং লামউভয়েই বদ্ধস্বর। তাহলে বলতে পারি করলামশব্দটির শরীর দুটি মাত্র বদ্ধস্বর দিয়ে গঠিত।
এবার সঙ্গোপনেশব্দটি গ্রহণ করা যায়। এ শব্দটি চারটি স্বর দিয়ে গঠিত সং, গো, , এবং নে,এটা স্পষ্ট, সং, বদ্ধস্বর এবং গো, , ও নে এরা প্রত্যেকটিই মুক্তস্বর। অর্থা সং উচ্চারণের সময় জিভ মুখের প্রবহমান বাতাসকে আটকে দেয় কিন্তু গো, প এবং নে উচ্চারণে জিভ সেটা করতে পারে না, ফলে মুখের ভেতরের বাতাস অনায়াসে বেরিয়ে আসে।
ছন্দের মূল আলোচনায় আসার আগে আরো একটি দিকে লক্ষ্য করা প্রয়োজন। তা হলোমাত্রাস্বর জানার পর মাত্রা সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান অর্জন সহজতর হবে।
বাংলা কবিতার সব ছন্দেই একটি মুক্তস্বর, সে যে অবস্থানেই থাকুন না কেনো, একটি মাত্র মাত্রা বহন করে।
কিন্তু সমস্যা হলো বদ্ধস্বর নিয়ে। একটি বদ্ধ স্বর কখনো একটি আবার কখনো দুটি মাত্রা বহন করে। অতএব পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনার মাধ্যমে বুঝে নেয়া দরকার বদ্ধস্বর কোন অবস্থায় একটি এবং কোন অবস্থায় দুটি মাত্রা বহন করে। অবশ্য তার আগে জানা চাই ছন্দের প্রকার ভেদ।
বাংলা কবিতার ছন্দ প্রধানত তিন প্রকার।
১. স্বরবৃত্ত ছন্দ
২. মাত্রাবৃত্ত ছন্দ
৩. অক্ষরবৃত্ত ছন্দ
স্বরবৃত্ত ছন্দ:
স্বরবৃত্ত ছন্দে বদ্ধস্বর এক মাত্রা বহন করে। কোনো অবস্থাতেই এ ছন্দে বদ্ধস্বর দুমাত্রা বহন করতে পারে না। তাছাড়া মুক্তস্বরের মাত্রা এক।
কবিতার পঙ্ক্তি দিয়ে বিবেচনা করা যাক।
১. মামার বাড়ি আর যাবো না আর খাবো না মামীর গাল,
কথায় কথায় পড়বে না আর আমার পিঠে অমন তাল।
এখানে প্রতি পঙ্ক্তিতে তিনটি করে পর্ব এবং একটি করে অতিপর্ব আছে। প্রত্যেক পর্বে সমান সংখ্যক মাত্রা আছে এবং লক্ষ্য করলে দেখা যাবে অতিপর্ব পর্ব থেকে কম সংখ্যক মাত্রা ধারণ করেছেছন্দ বিন্যাস করলে দেখা যায়,
মামার বাড়ি/ আর যাবো না/ আর খাবো না/ মামীর গাল,
কথায় কথায়/ পড়বে না আর/ আমার পিঠে/ অমন তাল।
স্বরের উপরে লম্বা দাগগুলো মাত্রা চিহ্ন নির্দেশক। মুক্ত স্বরের উপরে শুধু একটি দাগ দিলেও বদ্ধস্বর বোঝাতে চাঁদের মতো চক্র রেখা এঁকে তার উপরে মাত্রা চিহ্ন দেয়া হয়েছে। প্রতি লাইনে আড়াআড়ি দাগ কেটে পর্ব নির্দেশ করা হয়েছে।
পর্ব, অতিপর্ব ও উপপর্ব:
কবিতার প্রতিটি লাইনে সমমাত্রার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশই হলো পর্ব। পঙ্ক্তি শেষের পর্বাংশকে অতিপর্ব বলা হয় যার মাত্রা সংখ্যা পর্বের মাত্রা সংখ্যা থেকে সর্বদাই কম। এ ধরনের পর্বাংশ লাইনের শুরুতে থাকলে আমরা তাকে উপপর্ব বলে চিহ্নিত করবো।
উপরে প্রদত্ত উদাহণের ছন্দ বিন্যাস লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, প্রতিটি পর্বের মাত্রা সংখ্যা চার, এবং অতিপর্বের মাত্রা সংখ্যা তিন। এই কাব্যাংশে কোনো উপপর্ব নেই।
যদি কবিতাটি সম্পূর্ণ করার প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে প্রতিটি বর্ধিত লাইনেও উপরের লাইনগুলির সমান সংখ্যক পর্ব একই মাত্রায় রাখতে হবে, এবং অতিপর্বেও উপরের লাইন অনুসারে তিন মাত্রা থাকবে। যেমন,
মামার বাড়ি আর যাবো না আর খাবো না মামীর গাল,
কথায় কথায় আমার পিঠে পড়বে না আর অমন তাল।
সকাল বেলা জেগে আমি তাই তো গেলাম মায়ের ঘর,
ভায়ের বাড়ি যাওগে একা, আমার গায়ে ভীষণ জ্বর।
তাহলে স্বরবৃত্ত ছন্দের এই কবিতাটির কাঠামো দাঁড়াবে:
৪ + ৪ + ৪ + ৩
২. যখন ওরা অপিশে যায় কিংবা চালায়
তুমুল দোকানদারি
তখন আমি ঢেউ সাজানো নদীর বুকে
দিব্যি জমাই পাড়ি।
(
যখন ওরা/শামসুর রাহমান)
মাত্রা বিন্যাস:
যখন ওরা/ আপিশে যায়/ কিংবা চালায়/
তুমুল দোকান/ দারি
তখন আমি/ ঢেউ সাজানো/ নদীর বুকে/
দিব্যি জমাই/ পাড়ি।
কাঠামো:
৪ + ৪ + ৪
৪ + ২
এখানে চার মাত্রার চারটি পর্ব এবং দুই মাত্রার একটি অতিপর্ব দিয়ে পঙ্ক্তি গঠিত হয়েছে। সাথে সাথে লক্ষণীয় যে শামসুর রাহমান একটি পঙ্ক্তি ভেঙে দুটি লাইন করেছেন। কিন্তু পর্ব সংখ্যা প্রতি দুই দুই লাইনে সমান রেখেছেন। ইচ্ছা করলে প্রথম উদাহরণের কবিতাটি একই ভাবে ভেঙে দেয়া যায়। যেমন,
মামার বাড়ি আর যাবো না
আর খাবো না মামীর গাল,
কথায় কথায় পড়বে না আর
আমার পিঠে অমন তাল।
এই নতুন আঙ্গিকে কবিতাটির কাঠামো দাঁড়াবে:
৪ + ৪ +
৪ + ৩
প্রতি দুই লাইনে পর্ব সংখ্যা সমান রাখা হয়েছে।
৩. মেঘনা নদীর শান্ত মেয়ে তিতাসে
মেঘের মতো পাল উড়িয়ে কী ভাসে!
(
ভর দুপুরে/আল মাহমুদ)
মাত্রা বিন্যাস:
মেঘনা নদীর/ শান্ত মেয়ে/ তিতাসে
মেঘের মতো/ পাল উড়িয়ে/ কী ভাসে !
কবিতাটির কাঠামো:
৪ + ৪ + ৩
অর্থা এই কবিতায় কবি প্রতি লাইনে চার মাত্রার দুটি পর্ব এবং তিন মাত্রার একটি অতিপর্ব রেখেছেন।
উপরের উদাহরণগুলি থেকে দেখা যায় সব ক্ষেত্রেই প্রতিটি পর্বে চারমাত্রা এসেছে। তাহলে কি বলা যায়, স্বরবৃত্ত ছন্দে প্রতিটি পর্বে মাত্রা সংখ্যা চারে সীমাবদ্ধ থাকে? তাক্ষণিক উত্তর হ্যাঁ-সূচক।
তবে স্বরবৃত্ত ছন্দে কবিতার পর্বকে আরো এক প্রকার মাত্রার সমন্বয়ে গঠন করা যায়। সেটি হলো সাত মাত্রার মন্দাক্রান্তা ছন্দবা সংক্ষেপে মন্তাক্রান্তা ছন্দ। স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত উভয় ক্ষেত্রেই সংস্কৃত ধাচের এই বুনন সম্ভব। নাম থেকেই বোঝা যায় পর্বে মাত্রা সংখ্যা থাকবে সাতটি।
উদাহরণ:
৪. বাবুদের তাল পুকুরে
হাবুদের ডাল কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া
বলি থাম একটু দাঁড়া।
(
লিচু চোর/ কাজী নজরুল ইসলাম)
এখানে প্রতিটি লাইন সাত মাত্রার একটি মাত্র পর্ব দিয়ে গঠিত। আবার অন্যভাবে বলা যায় যে, প্রথমে তিন এবং পরে চার মাত্রার দুটি পর্ব দিয়ে লাইন গঠিত হয়েছে।
একই ছন্দে রচিত অন্য একটি কবিতার কথা বিবেচনা করা যায়,
৫. আগুনের পরশ মণি/ ছোঁয়াও পাণে,
এ জীবন পূণ্য করো/ দহন-দানে।
আমার এই দেহখানি/ তুলে ধরো,
তোমার ওই দেবালয়ের/ প্রদীপ করো
নিশিদিন আলোক-শিখা/ জ্বলুক গানে।
(
পরশমণি/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
লক্ষণীয় প্রতিটি লাইনের প্রথমে সাত মাত্রার একটি পর্ব ও শেষে চার মাত্রার একটি অতিপর্ব এসেছে।
এই বুননে কবিতাটির কাঠামো দাঁড়ায় :
৭ + ৪
৭ + ৪
তবে কেউ হয়তো বলতে পারেন, রবীন্দ্রনাথ এই কবিতায় তিন মাত্রার উপপর্ব রেখে চার মাত্রার পর্ব গঠন করেছেন। সেক্ষেত্রে মাত্রা বিন্যাস হবে নিন্মরূপ:
আগুনের পরশ মণি/ ছোঁয়াও পাণে,/
এ জীবন পূণ্য করো/ দহন-দানে।/
আমার এই দেহখানি/ তুলে ধরো,/
তোমার ওই দেবালয়ের/ প্রদীপ করো/
নিশিদিন আলোক-শিখা/ জ্বলুক গানে।/
কাঠামো:
+ ৪ + ৪
+ ৪ +৪
লক্ষণীয়, যে ভাবেই পড়া হোক না কেনো, কবিতার চাল প্রথম পর্বকে সাত মাত্রায় টেনে নিয়ে যায়।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ:
মাত্রাবৃত্তের ক্রিয়া কলাপ অনেকটা স্বরবৃত্তের মতো হলেও এই ছন্দে বদ্ধস্বর দুমাত্রা বহন করে। কোনো অবস্থাতেই বদ্ধস্বর একমাত্রা বহন করতে পারে না। কিন্তু স্বরবৃত্তের মতোই মুক্তস্বরের মাত্রা এক।
কবিতার পঙ্ক্তি দিয়ে বিবেচনা করা যায়।
১. মামার বাড়িতে/ যাবো না গো আমি/ খাবো না গো আর/ মামীর গাল,
কথায় কথায়/ পড়বে না আর/ পিঠের উপরে/ অমন তাল।
এখানে স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রথম উদাহরণটি একটু ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি লাইনে এবার ছয় মাত্রার তিনটি করে পর্ব এবং পাঁচ মাত্রার একটি করে অতিপর্ব এসেছে।
মাত্রা বিন্যাস:
মামার বাড়িতে/ যাবো না গো আমি/ খাবো না গো আর/ মামীর গাল,
কথায় কথায়/ পড়বে না আর/ পিঠের উপরে/ অমন তাল।
অতএব কবিতাটির কাঠামো দাঁড়ায় :
+ + ৬ + ৫
অতিপর্বের মাত্রা সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়, তবে কিছুতেই তা পর্বের মাত্রা সংখ্যার সমান হবে না। অতিপর্বের মাত্রা সংখ্যা যদি পর্বের মাত্রা সংখ্যার সমান হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে অতিপর্ব একটি পূর্ণ পর্বের রূপ নেবে। এখানে বলে রাখা ভালো, অতিপর্ব ছাড়াও শুধু পর্ব দিয়ে কবিতার কাঠামো তৈরি করা যায়। মাত্রা বিন্যাস সহ আরো কিছু কবিতার উদাহরণ:
ছয় মাত্রার পর্ব এবং চার মাত্রার অতিপর্ব:
২. কবি বন্ধুরা/ হতাশ হইয়া/ মোর লেখা পড়ে/ শ্বাস ফেলে
বলে কেজো ক্রমে/ হচ্ছে অকেজো/ পলি টিক্সের/ পাশ ঠেলে।
(
আমার কৈফিয়/ কাজী নজরুল ইসলাম)
কবিতাটির কাঠামো:
৬ + ৬ + ৬ + ৪
ছয় মাত্রার পর্ব এবং তিন মাত্রার অতিপর্ব:
৩. সই পাতালো কি/ শরতে আজিকে/ স্নিগ্ধ আকাশ/ ধরণী ?
নীলিমা বহিয়া/ সওগাত নিয়া/ নমিছে মেঘের/ তরণী !
(
রাখী বন্ধন/ কাজী নজরুল ইসলাম)
কাঠামো:
৬ + ৬ + ৬ + ৩
ছয় মাত্রার পর্ব এবং দুই মাত্রার অতিপর্ব:
৪ক. এ জগতে হায়/ সেই বেশি চায়/ আছে যার ভূরি/ ভূরি
রাজার হস্ত/ করে সমস্ত/ কাঙালের ধন/ চুরি।
(
দুই বিঘে জমি/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
খ. দুর্গম গিরি/ কান্তার মরু/ দুস্তর পারো/ বার
লঙ্ঘিতে হবে/ রাত্রি নিশিতে/ যাত্রীরা হুশি/ য়ার।
(
কাণ্ডারী হুশিয়ার/ কাজী নজরুল ইসলাম)
কাঠামো:
৬ + ৬ + ৬ + ২
পাঁচ মাত্রার পর্ব কিন্তু অতিপর্ব নেই:
৫. তোমারে পাছে/ সহজে বুঝি/ তাই কি এতো/ লীলার ছল/
বাহিরে যবে/ হাসির ছটা/ ভিতরে থাকে/ আখির জল।/
(
ছল/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
কাঠামো:
৫ + ৫ + ৫ + ৫
পাঁচ মাত্রার পর্ব এবং দুমাত্রার অতিপর্ব:
৬ক. এ-ভূজমাঝে/ হাজার রূপ/ বতি
আচম্বিতে/ প্রাসাদ হারা/ য়েছে;
অমরা হতে/ দেবীরা সুধা/ এনে,
গরল নিয়ে/ নরকে চলে/ গেছে।
(
নিরুক্তি/ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত)
কাঠামো:
৫ + ৫ + ২
খ. হৃদয়ে তার/ অন্ধকার/ পৃথিবী নিঝ/ ঝুম
বিফল তার/ সকল বৈ/ভব
ভাঙে না তার/ বসন্তের/ অন্তহীন/ ঘুম
জাগে না কল রব/
কপালে যার/ আঁকেনি কেউ/ প্রেমের কুম/ কুম
ব্যর্থ তার/ সব।
(
মধ্য ফাল্গুনে/নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)
কাঠামো:
৫ + ৫ + ৫ + ২
৫ + ৫ + ২
গ. তখনো ছিলো/ অন্ধকার/ তখনো ছিলো/ বেলা
হৃদয় পুরে/ জটিলতার/ চলিতেছিলো/ খেলা
ডুবিয়াছিলো/ নদীর ধার/ আকাশে আধো/ লীন
সুষমাময়ী/ চন্দ্রমার/ নয়ান ক্ষমা/ হীন
(
হৃদয়পুর/শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
কাঠামো:
৫ + ৫ + ৫ + ২
আট মাত্রার পর্ব এবং ছয় মাত্রার অতিপর্ব:
৭. শেফালি কহিল আমি/ ঝরিলাম তারা !
তারা কহে আমারো তো/ হল কাজ সারা।
(
এক পরিণাম/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
কাঠামো:
৮ + ৬
এখানে বলে রাখা ভালো এ কাঠামোর কবিতাকে আট-ছয় মাত্রার কবিতাও বলা যেতে পারে। চৌদ্দ মাত্রার সনেট সৃষ্টির কাজে এ ধরনের ছন্দ বিন্যাস বিশেষ ব্যবস্থায় কাজে লাগানো যায়। তাছাড়া অক্ষরবৃত্ত ছন্দে এর উপস্থিতি অনেক বেশি।
মাত্রাবৃত্তে সাত মাত্রার পর্বের ব্যবহার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অনেকটা স্বরবৃত্তের মতোই তবে মাত্রাবৃত্তে অতিপর্ব রাখাটা বেশ সহজতর। প্রথমে অতিপর্বহীন কয়েকটি কবিতার উদাহরণের দিকে তাকানো যাক।
সাত মাত্রার দুই পর্ব বিশিষ্ট কবিতা:
৮. তোমার মুখ আঁকা/ একটি দস্তায়/
লুটিয়ে দিতে পারি/ পিতার তরবারি/
বাগান জোত জমি/ সহজে সস্তায়/
তোমার মুখ আঁকা/ একটি দস্তায়;/
(
শোণিতে সৌরভ/ আল মাহমুদ)
কাঠামো:
৭ + ৭
সাত মাত্রার তিন পর্ব বিশিষ্ট কবিতা:
৮. উগ্র ঢাল, তার/ তীক্ষè শরমুখ/ রঙিন, কোপনীয়/
রেখেছে সঞ্চিত/ যা-কিছু মায়াময়,/ মধুর, গোপনীয়
(
সুন্দর জাহাজ/অনু: বুদ্ধদেব বসু)
কাঠামো:
৭ + ৭ + ৭
সাত মাত্রার চার পর্ব বিশিষ্ট কবিতা:
৯.
অন্ধ রেল গাড়ি/ বধির রেলগাড়ি/ অন্ধ রেল বেয়ে/ চলছে দ্রুত বেগে/
দু-চোখে মরা ঘুম/ আকাশে মরা মেঘ/ সঙ্গে মরা চাঁদ/ অন্ধ আছি জেগে/
অন্ধ বগিগুলো/ ক্লান্ত হয়ে গেছে/ এগিয়ে চলে তবু/ অন্ধ প্রতিযোগী/
চলছে ট্রাগ বেয়ে/ জানে না কোথা যাবে/ নষ্ট রেলগাড়ি/ অন্ধদূর বোগী।/
(
অন্ধ রেলগাড়ি / হুমায়ুন আজাদ)
কাঠামো:
৭ + ৭ + ৭ + ৭
সাত মাত্রার মাত্রাবৃত্তে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার অতিপর্ব ব্যবহারের নমুনা:
১০. ফসল অন্যের,/ তোমার শুধু
অন্য কোনো দূর/ অরণ্যের
পন্থহীনতায়/ স্বপ্নে কেঁপে ওঠা/
কোন অসম্ভব/ আকাক্সক্ষায়।
(
অসম্ভবের গান/বুদ্ধদেব বসু)
কাঠামো:
৭ + ৫
৭ + ৫
+
৭ + ৬
এই চার লাইনে অতিপর্বে কোথাও পাঁচ কোথাও ছয় মাত্রা রাখা হয়েছে। কিন্তু তৃতীয় লাইনে কোনো অতিপর্ব নেই। ফলে, তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন মিলে একটি পঙ্ক্তি তৈরী করেছে।
১১. নিমেষে ভুলি সাধ/ অতল মোহে।
মোহিনী ও-মুখের/ মিথ্যা বুলি
সত্য সার ভাবি,/ এবং আমি
ধারি না ধার কোনো/ মহোদয়ের।
(
কবর খোড়ার গান/শামসুর রাহমান)
কাঠামো:
৭ + ৫
৭ + ৫
এই কবিতায় পাঁচ মাত্রার অতিপর্ব রাখা হয়েছে।
১২. যেখানে লেজবস/ প্রণয় ঝর্ণায়/ উলঙ্গ
শান্ত বয়ে যায়/ গভীর শেষমেশ/ সমুদ্রে
ভাসিয়ে প্রান্তর/ যায় সে আঁকাবাঁকা/ খলখল
ঝঞ্ঝা গোপনীয়,/ দেবতা ভূমিতলে/ অসংখ্য
যেখানে লেজবস/ প্রণয় ঝর্ণায়/ উলঙ্গ।
(
লেসবস/অনু: হাসানআল আব্দুল্লাহ)
কাঠামো:
৭ + ৭ + ৪
৭ + ৭ + ৪
বোদলেয়ার রচিত এই কবিতাটি অনুবাদে অতিপর্বে চার মাত্রা রাখা হয়েছে। দুটি করে পর্ব দিয়ে কবিতার লাইন গঠিত।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ:
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে বদ্ধস্বর কখনো একমাত্রা এবং কখনো দুই মাত্রা বহন করে। অর্থা পর্বে মাত্রা গণনা রীতি কোথাও স্বরবৃত্তের আবার কোথাও মাত্রাবৃত্তের মতন। বদ্ধস্বর যদি শব্দের প্রথম বা মাঝে থাকে তবে তা এক মাত্রা কিন্তু শব্দের শেষে অবস্থান করলে দুই মাত্রা বহন করে। উদাহরণ স্বরূপ সূর্যশোকশব্দটি বিবেচনা করা যেতে পারে।
স্বর বিন্যাসে শব্দটি নতুন করে লিখে আমরা পাই:
সূর + য + শোক
প্রথম এবং শেষেরটি বদ্ধস্বর, কিন্তু মাঝেরটি মুক্তস্বর। সূরবদ্ধস্বরটি শব্দের প্রথমে থাকায় এর মাত্রা সংখ্যা এক। অন্যদিকে শোকবদ্ধস্বরটি শব্দের শেষে থাকায় এর মাত্রা সংখ্যা দুই। আর মুক্ত স্বর ”-এর মাত্রা সংখ্যা সর্বদাই এক। অতএব অক্ষরবৃত্তের এই নিয়মে সূর্যশোকএর মাত্রা সংখ্যা চার।
মাত্রা বিন্যাস:
সূর্যশোক
সূর + + শোক
=
১ + ১ + ২
=
মাত্রা বিন্যাস সহ অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত কয়েকটি কবিতা।
পর্বে আট মাত্রা এবং অতিপর্বে ছয়মাত্রা আছে এমন একটি কবিতা:
১. হাজার বছর ধরে/ আমি পথ হাঁটিতেছি/ পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে/ নিশীথের অন্ধকারে/ মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি ;/ বিম্বিসার অশোকের/ ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি;/ আরো দূর অন্ধকারে/ বিদর্ভ নগরে;
(
বনলতা সেন/ জীবনানন্দ দাশ)
কাঠামো:
৮ + ৮ + ৬
এখানে সংহল” “সমুদ্র” “অন্ধকারএবং বিম্বিসারশব্দ চারটি লক্ষ্য করা যায়। প্রথম শব্দ দুটি তিনটি করে এবং শেষের শব্দ দুটি চারটি করে মাত্রা বহন করছে।
এদের স্বর ও মাত্রা বিন্যাস নিম্নরূপ:
সিংহল
সিং + হল
=
১ + ২
=
সমুদ্র
স + মুদ + রো
=
১ + ১ + ২
=

অন্ধকার
অন্ + ধো + কার
=
১ + ১ + ২
=
বিম্বিসার
বিম + বি + সার
=
১ + ১ + ২
=

দেখা যাচ্ছে, শব্দের প্রথমে এবং মাঝে অবস্থিত বদ্ধস্বরগুলি এক মাত্রা কিন্তু শেষে অবস্থিত বদ্ধস্বরগুলি দুমাত্রা বহন করছে।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে মাত্রা গণনার এই রীতি কবি ইচ্ছা করলে বদলে দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে সব বদ্ধস্বরকে দিতে হবে দুমাত্রা বহন করার ক্ষমতা। তবে, সতর্ক থাকা প্রয়োজন, যাতে পুরো কবিতায় একই নিয়ম প্রতিফলিত হয়। এক কবিতায় দুরকম নিয়ম অনুসরণ করলে একদিকে পাঠক যেমন বিভ্রান্ত হবেন, অন্যদিকে কবিরও ছন্দে অদক্ষ হাতের প্রমাণ থেকে যাবে।
সকল বদ্ধস্বরকে দুমাত্রা বহন করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এমন একটি কবিতা:
২. বহুদিন থেকে আমি/ লিখছি কবিতা
বহুদিন থেকে আমি/ লিখিনা কবিতা
(
বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা/ সৈয়দ শামসুল হক)
কাঠামো:
৮ + ৬
এখানে লিখছিশব্দটির লিখবদ্ধস্বরটি শব্দের প্রথমে বসেও দুই মাত্রা বহন করছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রম। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে, এটা কবির ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।
শব্দের প্রথম ও মাঝের বদ্ধস্বরকে একমাত্রা দেয়া হয়েছে এমন আরো দুটি কবিতা:
৩.রহে বলী; রাজদণ্ড/ যত খণ্ড হয়
তত তার দুর্বলতা,/ তত তার ক্ষয়।
একা সকলের উর্ধ্বে/ মস্তক আপন
যদি না রাখিতে রাজা,/ যদি বহুজন
(
গন্ধারীর আবেদন/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
কাঠামো:
৮+৬
৪. হে দারিদ্র্য তুমি মোরে/ করেছ মহান
তুমি মোরে দানিয়েছ/ খ্রীস্টের সম্মান।
কণ্টক-মুকুট শোভ!/ দিয়াছ, তাপস
অসঙ্কোচ প্রকাশের/ দুরন্ত সাহস:
(
দারিদ্র / কাজী নজরুল ইসলাম)
কাঠামো:
৮ + ৬
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এ দুটি কবিতাই চোদ্দ মাত্রার সনেট নির্মাণের কাজে অবদান রাখতে পারে। সনেট অধ্যায়ে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।
এবার অন্য একটি কবিতা:
৫. ক্রূর ঝড় থেমে গেছে,/ এখন আকাশ বড়ো নীল/
গাছের সবুজ পাতা/ কেঁপে কেঁপে অত্যন্ত সুষম/
বিন্যাসে আবার স্থির/
(
বাজপাখি / শামসুর রাহমান)
এই কবিতাটির প্রতিটি লাইনের প্রথম পর্ব আট মাত্রা এবং দ্বিতীয় পর্ব দশ মাত্রা বহন করছে। যদি পর্বের আলোচনার আলোকে এটা বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে বলা যায় শেষের দশ মাত্রার পর্বটি অতিপর্ব। কিন্তু তা কি করে হয়? অতিপর্বের মাত্রা তো পর্বের মাত্রা সংখ্যা থেকে কম হওয়ার কথা। তবে কি এক্ষেত্রে মন্তব্য করা যাবে যে কবিতাটি লেখা হয়েছে ৮+৮+২ কাঠামোতে অর্থা আট মাত্রার দুটি পর্ব এবং দুই মাত্রার অতিপর্ব রেখে। কিন্তু তাও ঠিক নয়। কারণ, প্রথম লাইনের নীলশব্দটি দুইমাত্রা বহন করায় এটাকে দুই মাত্রার অতিপর্ব ধরলেও ধরা যায়। কিন্তু সমস্যা হয় দ্বিতীয় লাইনের সুষমশব্দটিকে নিয়ে। দুই মাত্রার অতিপর্ব বের করতে হলে সুষমথেকে সুস্বরটিকে পূর্বের পর্বের সঙ্গে যুক্ত করতে হয়, এবং ষমকে অতিপর্ব ধরতে হয়। অর্থা তিন অক্ষরের এই শব্দটিকে ভেঙে দিয়ে কবিতার পর্ব বিন্যাস করতে হয়। এক্ষেত্রে যা যুক্তিপূর্ণ নয়। তাই এই কবিতাটিকে আট-দশমাত্রার বা আট-দশচালের কবিতা বলা প্রয়োজন, যা অক্ষরবৃত্তে কবিতা লেখার অন্য একটি নিয়ম হিসেবে বেশ কয়েক যুগ ধরে বাংলা কবিতায় প্রচলিত এবং এটাই হচ্ছে আঠারো মাত্রার সনেট গঠনের নির্ভরযোগ্য কাঠামো।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আলোচনায় অগ্রসর হলে মনে হতে পারে যে এর অঙ্গন অনেক প্রশস্ত এবং কিছুটা খোলামেলা।
আসলেই তাই। বাংলা কবিতার ত্রিশের দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবিরা অক্ষরবৃত্তের উপর প্রচুর কাজ করেছেন এবং একে একটা মুক্ত রূপ দিয়েছেন; যা অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মাত্রা গণনার নিয়মকে ঠিক রেখে পর্বে মাত্রা বাড়িয়ে কমিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পর্ব ভেঙেচুরে ছন্দকে শাসন করে সজোরে আছাড় মেরে কবিতাকে সোজা করে দাঁড় করা হয়েছে। উঁকি দিয়েছে অক্ষরবৃত্তের নতুন ধারা। অক্ষরবৃত্তের এই নতুন রূপকে অনেকে মুক্ত ছন্দবলেন। কিন্তু আমরা একে নঞ ছন্দবলবো। নাই অর্থে নঞ। অর্থা সাধারণ ভাবে দেখলে কবিতায় ছন্দ নেই, কিন্তু বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করলে ছন্দের দৃঢ় বন্ধন দৃষ্টিগোচর হয়। নঞ ছন্দের উদাহরণ লক্ষ্য করা যাক:
১. আকাশ জানে না,/
প্রকাশ রাস্তায় একী/ কুড়ানো স্বাক্ষর,/
নক্ষত্র সমাজ খোঁজে/ শেষ পরিচয়/
ওরা পরস্পর/
নূতন বিরহে পায়/ অভিন্ন বিচ্ছেদে দীপ্তিময়/
উদ্ভাসিত দূরে দূরে/ অনন্ত বাসর।/
(
যুগ্মদূর/ অমিয় চক্রবর্তী)
কাঠামো:

৮ + ৬
৮ + ৬

৮ + ১০
৮ + ৬
২. সজীব সকালে চোখ মেলি,/ প্রতিদিনের পৃথিবী/
আমাকে জানায় অভি/ বাদন। টাটকা রোদ
পাখিদের উড়াউড়ি,/ গাছের পাতার দুলুনি,/ বেলফুলের গন্ধ/
ডেকে আনে আমার বালকবেলাকে/
(
একটি দুপুরের উপকথা / শামসুর রাহমান)
কাঠামো:
১০ + ৮
৮ + ৮
৮ + ৮ + ৮
১৪
৩. যখন তাদের দেখি/ হঠা আগুন লাগে/ চাষীদের মেয়েদের/
বিব্রত আঁচলে;/ সমস্ত শহর জুড়ে/ শুরু হয় খুন, লুঠ,/ সম্মিলিত অবাধ ধর্ষণ,
ভেঙে পড়ে শিল্পকলা,/ গদ্যপদ্য;/ দাউদাউ পোড়ে/ পৃষ্ঠা সমস্ত গ্রন্থের;
ডাল থেকে/ গোঙিয়ে লুটিয়ে পড়ে/ ডানা ভাঙা নিঃসঙ্গ দোয়েল
আর্তনাদ করে বাঁশি/ যখন ওঠেন মঞ্চে/ রাজনীতিবিদগণ।
(
রাজনীতিবিদগণ/ হুমায়ুন আজাদ)
কাঠামো:
৮ + ৮ + ৮
৬ + ৮ + ৮ + ১০
১০ + ৪ + ৬ + ৮
৪ + ৮ + ১০
৮ + ৮ + ৮
এইসব উদাহরণ থেকে এটা স্পষ্ট যে পর্বে মাত্রা সংখ্যা অসমান; কিন্তু জোড় মাত্রার পর্ব গঠিত হয়েছে।
মুক্ত বা নঞ ছন্দে কবিতা লেখার সহজ উপায়
এখন প্রশ্ন হলো মুক্ত বা নঞ ছন্দে কবিতা লেখার নিয়ম কি? এ ছন্দে লেখা কবিতাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে যা ধরা পড়বে তা হলো:
১. অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মাত্রা গণনার নিয়ম ঠিক থাকবে।
২. প্রতিটি পর্বে জোড়সংখ্যক মাত্রা থাকতে হবে।
৩. পর্বে মাত্রা সংখ্যা দুই থেকে শুরু করে চার, ছয়, আট, দশ যে কোনো সংখ্যক রাখা যেতে পারে।
মুক্ত বা নঞ ছন্দে কবিতা লেখার সময় যদি একটা বিশেষ নীতি মেনে চলা হয় তবে উপরের তিনটি শর্তই একসঙ্গে পূরণ করা সম্ভব। নীতিটি হলো:
জোড়ে জোড়, বিজোড়ে বিজোড়।
তার মানে জোড় মাত্রার শব্দের পাশাপাশি জোড় মাত্রার শব্দ এবং বিজোড় মাত্রার শব্দের পাশাপাশি বিজোড় মাত্রার শব্দ বসানো। এরপর ইচ্ছা মতো লাইন তৈরি করা হলেও ছন্দের কোনো বিচ্চুতি ঘটে না।
——————————————————–
কবিতার ছন্দ, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৭ ।। দ্বিতীয় সংস্করণ: মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিতব্য, ফেব্রুয়ারী, ২০১১।। এই অধ্যায়টি মুক্তমনা বন্ধুদের জন্যে তুলে দিলাম। স্বরের উপর দাগ দেওয়ার কথা বলা আছে কিন্তু কম্পিউটারে তা সম্ভব হলো না। তারপরেও আমার মনে হয় মাত্রা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়।
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  • http://mukto-mona.com/bangla_blog/wp-content/plugins/sociable/images/more.png
Top of Form
Bottom of Form
সেপ্টেম্বর ৩, ২০১০১১:০৪ পূর্বাহ্ণ


লেখাটি ১৪৬৩ বার পঠিত  হয়েছে

পোস্ট কিংবা মন্তব্যে প্রকাশিত মতামত কোন অবস্থাতেই মুক্তমনা কর্তৃপক্ষের মতামতের প্রতিফলন নয়। বক্তব্যের দায়ভার লেখক এবং মন্তব্যকারীদের নিজেদের। এর জন্য মুক্তমনা ব্লগ কর্তৃপক্ষকে কোনভাবেই দায়ী করা চলবেনা।
১৮ মন্তব্য
  1. 1
সেপ্টেম্বর ৩, ২০১০ সময়: ১২:২৭ অপরাহ্ণ লিঙ্ক
কোন কথা নাই, না পড়েই আগে ধন্যবাদ দিয়ে নেই। পড়ে আবার মন্তব্য করব। হাসান ভাই অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ এই লেখাটার জন্য।
  1. 2
সেপ্টেম্বর ৩, ২০১০ সময়: ৯:৫৬ অপরাহ্ণ লিঙ্ক
হাসান
কেমন আছেন? অনেকদিন ধরে একটা একটা প্রশ্ন করতে চাই, আপনি তো অনেক আন্তর্জাতিক কবির সাথে কাজ করেন আপনিই হয়তো আমাকে এর উত্তর দিতে পারবেন। আচ্ছা, আমাদের দেশের লেখালিখি, ব্লগ, পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন খুললেই কবিতার ছড়াছড়ি দেখা যায়। এখানে তো কোন মিডিয়া, বইএর দোকান বা পত্রপত্রিকায় সেভাবে কবিতা দেখি না। পৃথিবীর সব দেশের মানুষই কি আমাদের মত এত কবিতা লেখে? নাকি এ বিষয়ে আমার জ্ঞান সীমিত দেখে আমি ঠিকমত দেখতে পাচ্ছি না? অনেক দিন ধরেই কাউকে জিজ্ঞেস করবো ভাবছি, কিন্তু ঝাড়ি খাওয়ার ভয়ে প্রশ্নটা করিনি। ভাবলাম আপনাকেই করি, আপনি হয়তো আমার অজ্ঞানতাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে উত্তরটা দিবেন :-?.
হাসানআল আব্দুল্লাহ
হাসানআল আব্দুল্লাহ এর জবাব:
সেপ্টেম্বর ৩, ২০১০ at ১১:২৭ অপরাহ্ণ
@বন্যা আহমেদ,
একজন বিজ্ঞানি উদ্বিগ্ন কবিতা নিয়ে। অন্ততঃ আপনার প্রশ্নে যা বুঝতে পারছি ভালো কবিতা না হওয়া নিয়ে আপনার এই উদ্বেগ কবিদেরকে আশার আলো দেখাবে। তবে কেউ কেউ তো আলো হাতে চলিয়াছে’, চলিতেছে।
আমারও একসময় মনে হতো কবিতা নিয়ে বুঝি আমাদের দেশেই অমন বাড়াবাড়ি। কিন্তু মার্কিন কবিতার সাথে, বা বলা যায় কবিদের সাথে, যখন যোগাযোগ শুরু হলো, অবাক হয়ে দেখলাম, একি এরা তো আমাদের থেকে কয়েকশগুণ বেশী বাড়ছে! শুনে মন খারাপ করবেন না যে, এই নিউইয়র্ক শহরে (পাঁচ বোরে) প্রতিদিন প্রায় পাঁচশকবিতার আসার বসে। আর কতো যে ম্যাগাজিন! সোহোতে একটা মাগাজিনের দোকান আছে, ওখানে গেলে যে কারো পিলে চমকে যাবার কথা, হাজার হাজার কবিতা-জার্নাল! তবে সুখের কথা হলো যে হাজার হাজার অন্যান্য বিষয়ের জার্নালও দেখা যায়। আর আমাদের তো শুধু ঢাকা মুখি। এদের পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্যের প্রায় সবগুলো বড়ো শহর কেন্দ্রীক এই উন্মাদনা। তবে, ব্যতিক্রম হলো, বাংলাদেশে দৈনিকের সাময়িকীতে কবিতা ছাপা হয়। এটা এখানে হয় না। আমাদের তরুণ কবিরা অধিকাংশই তরুণ, কিন্তু এখানকার তরুণ কবিরা অধিকাংশই রিটায়ার্ড।
সুযোগ হলে একবার নিউজার্সির ডজ পোয়ের্টি উসবএ আসুন। তিন দিন ধরে দশ-পনের হাজার মানুষের ঢল নামে ওখানে। এমন উসব বড়ো বড়ো শহরকে ঘিরে যথেষ্ট আছে। লন্ডন ও প্যারিসের অবস্থাও প্রায় একই রকম।তবে ভালো কবিতার অভাব সবখানে। ভালো কবি প্রতিদিন আসে না, একজন বড়ু চণ্ডীদাসের পর আরেক চণ্ডীদাসকে পেতে দুশবছর অপেক্ষা করতে হয়। আর সেখান থেকে মধুসুদন দত্তর দূরত্বও প্রায় দেড়শবছরের। ইংরেজীতেও প্রায় একই রকম দেখা যায়, একজন চসারের পরে একজন শেক্সপীয়র আসতে প্রায় পোনে দুশবছর লাগে। তবে স্বীকার করতেই হবে, রোমান্টিক ও আধুনিক কালে (উভয় ভাষায়) আমরা অল্প সময়ে অনেকগুলো বড়ো কবি পেয়ে গেছি। হয়তো কবিতায় উন্মাদনা আসার এটাও একটি প্রধান কারণ। এই উত্তরটা লেখার সময় কৌতূহল বসত গুগলে আমেরিকান পোয়েট্রিলিখে সার্চ করে এক কোটি নয় লক্ষ এন্ট্রি পেলাম। অবস্থাটা বুঝুন! আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপনের জন্যে।
  1. 3
http://mukto-mona.com/bangla_blog/wp-content/plugins/profile-pic/pics/154.jpgআফরোজা আলম
সেপ্টেম্বর ৩, ২০১০ সময়: ১০:২৫ অপরাহ্ণ লিঙ্ক
@ : হাসানআল আব্দুল্লাহ
১. স্বরবৃত্ত ছন্দ
২. মাত্রাবৃত্ত ছন্দ
৩. অক্ষরবৃত্ত ছন্দ
ছন্দের উপরে লেখা পড়ে অভিভুত হলাম। অনেক ধন্যবাদ। :-)
  1. 4
সেপ্টেম্বর ৪, ২০১০ সময়: ১২:৩৫ পূর্বাহ্ণ লিঙ্ক
লেখাটি পড়ে অনেককিছু শিখলাম। ধন্যবাদ হাসানআল আব্দুল্লাহ ভাইকে
হাসানআল আব্দুল্লাহ
হাসানআল আব্দুল্লাহ এর জবাব:
সেপ্টেম্বর ৪, ২০১০ at ৪:৩২ পূর্বাহ্ণ
@মোজাফফর হোসেন,
ধন্যবাদ মোজাফফর। আসলে ছন্দ অনেকটা গণিতের হিসাবের মতো। অন্যদিকে কানকে সতর্ক রাখলেই ছন্দ পতন ধরা যায়। লেখাটি তোমার উপকারে এসেছে জেনে খুশী হলাম।
সাইফুল ইসলাম ও আফরোজা আলমকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আশা করি লেখাটি বেশী গাণিতিক হয়ে যায়নি। অনেক দিন আগে অঙ্গিকার করেছিলাম যে
মুক্তমনায় এ ধরনের একটি লেখা দেবো। কাজটি করতে পেরে এক প্রকার ভালোই লাগছে।
http://mukto-mona.com/bangla_blog/wp-content/plugins/profile-pic/pics/154.jpg
আফরোজা আলম এর জবাব:
সেপ্টেম্বর ৪, ২০১০ at ৯:১১ পূর্বাহ্ণ
@হাসানআল আব্দুল্লাহ,
আপনি বিদেশের সাহিত্য বিশেষতঃ কবিতার যে খবরটা জানালেন ভালোলাগলো জেনে। আমি শখে লিখি তবু প্রায়শঃ শুনতে হয়কবিদের ভাত নেইজানি কথাটা নির্মম সত্য।কিন্তু ,
সত্যরে বাসিয়াছি ভালো
সে কখনও করেনা বঞ্চনা
http://0.gravatar.com/avatar/8e75b8855a837345d1fc9a4094a1ce6a?s=32&d=identicon&r=G
গীতা দাস এর জবাব:
সেপ্টেম্বর ৪, ২০১০ at ১১:০৫ পূর্বাহ্ণ
@হাসানআল আব্দুল্লাহ,
পুরানো পড়াকে ঝালাই করার সুযোগ পেলাম।এজন্য ধন্যবাদ।
অনুরোধ রইল কবিতায় চিত্রকল্প, উপমা, প্রেক্ষা, রূপক নিয়ে আরেকটি লেখার জন্য।

হাসানআল আব্দুল্লাহ এর জবাব:
সেপ্টেম্বর ৪, ২০১০ at ১১:৩৫ অপরাহ্ণ
@গীতা দাস,
অনুরোধ রইল কবিতায় চিত্রকল্প, উপমা, প্রেক্ষা, রূপক নিয়ে আরেকটি লেখার জন্য।
দেখি উপমা অনুপ্রাস চিত্রকল্পনামে ওই বইয়ে লেখা প্রবন্ধটি দেওয়া যায় কি না। আপনাকে ধন্যবাদ।
  1. 5
সেপ্টেম্বর ৪, ২০১০ সময়: ৭:১৩ পূর্বাহ্ণ লিঙ্ক
আপনার প্রবন্ধটা আমাকে ছন্দ বুঝতে অনেক সাহায্য করবে। ধন্যবাদ। :yes:
  1. 6
সেপ্টেম্বর ৪, ২০১০ সময়: ৭:৩২ অপরাহ্ণ লিঙ্ক
যখন আবৃত্তি করতাম, তখন ছন্দ পড়ে করিনি। কিন্তু একটা সময় মনে হয়েছে, কোনকিছু করলে শিখে পড়েই করা ভালো। কন্ঠশীলনে ক্লাস করতেও শুরু করেছিলাম এজন্য। অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় আর সেযাত্রায় পথ চলা হয়নি। স্কুল কলেজের আবৃত্তিগুলো হত কেবলই আবেগ আর কানের সাধনায় কন্ঠস্বরের উত্থান পতনে। অন্ধের মত সেই পথচলা অপূর্ণ হলেও একদম খারাপ লাগেনি আমার।
এখন ছন্দের অভাবটা বেশ বোধ করি। মাঝে মাঝে সাহস করে টুকটাক কবিতা লেখার অপপ্রয়াস চালালে, কেন যেন মনে হয়, সবটুকু অনুভূতি দিয়েও একটা অপূর্ণতা ঠিকই রয়ে গেল, সে ছন্দ! এইসব অপূর্ণতার বেড়াজালে, মন হারিয়ে গেছে কেবলই কবিতার বক্তব্যে, ছন্দকে ফাঁকি দিয়ে। এই ফাঁকটা পূরণের খুব ইচ্ছা আমারকেমন যেনো কন্ঠে সুর না লাগার মত ব্যাপার হয়ে গেছে।
অনেক ধন্যবাদ, এই লেখাটির জন্য। :rose2:
  1. 7
সেপ্টেম্বর ৪, ২০১০ সময়: ৯:৪০ অপরাহ্ণ লিঙ্ক
যারা কবিতার চর্চার করছেন, তাদের জন্য লেখাটা খুবই উপকারী; এতে কোনোই সন্দেহ নেই।
আমার মনে পড়ছে, আপনি এক সময় ছন্দ বিষয়ক লেখা মুক্তমনায় দিতে চেয়েছিলেন। আপনি আপনার কথা রেখেছেন। আপনি সত্যিই কথা রাখনেওয়ালা এক সুন্দর মনের কবি।
মুক্তমনার চারজন কবি যথা: আফরোজা আলম, লাইজু মান নাহার, সাইফুল ইসলাম আর মোজাফফর হোসেন। আপনি বাদ, কারণ আপনি হচ্ছেন গুরু। গুরুর কাছ থেকে এমন লেখা পেয়ে আনন্দে নেচে ওঠার কথা। আমি যদি কবিতা চর্চা করতাম, তাহলে ঠিকই নেচে উঠতাম।
কয়েকদিন আগে আরজ আলী মাতুব্বরের কয়েকটি কবিতা পড়লাম। প্রতিটি লাইনের আদ্যাক্ষর দিয়ে মানুষের নাম হয়ে যায়। পড়তে বড় ভালো লাগে। এধরনের কবিতাকে কি অক্ষরবৃত্ত?
আপনার এই ছন্দের উপর লেখা পড়ে কবি হওয়ার বাসনা জেগেছে মনে। হাসান ভাই, কবিতা লিখতে পারবো তো?
আমার একটা প্রশ্ন জাগে মনে; যারা স্বভাব কবি, তাদের কি এমন ছন্দ- মাত্রা সম্পর্কিত ব্যাকরণ জানার প্রয়োজন পড়ে কি-না?
হাসানআল আব্দুল্লাহ
হাসানআল আব্দুল্লাহ এর জবাব:
সেপ্টেম্বর ৪, ২০১০ at ১১:২৯ অপরাহ্ণ
@মাহফুজ,
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। বিনয়ের সাথে আপনার গুরুশব্দটিকে প্রত্যাখ্যান করছি। কালই ই-চিঠিতে একজনকে লিখেছিলাম, “এটা আমাদের সামাজিক অভ্যাস।আমিও কবি, কবিতা নিয়ে চিন্তা করি। মনের ভাষাকে শব্দবন্ধের বিভিন্ন খেলায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি। এই যে খেলাশব্দটি ব্যবহার করলাম। সম্ভবত এটাই ছন্দ। এবং কিছু অলঙ্কারও এর সাথে জড়িত। যেমন, আপনি লাইনের আদ্যাক্ষরে কারো নাম হয়ে যাওয়ার কথা বলেছেনএটাও একটা খেলা বই অন্য কিছু নয়। তবে এটা ছন্দের নয়, অলঙ্কারের খেলা। ইংরেজীতে একে বলে অ্যাক্রস্টিক(Acrostic)স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত যেকোনো ছন্দে এমন কবিতা লেখা যেতে পারে। খুব সত্য যে, মার্কিন দেশে এই ধরনের কবিতা লেখানো হয় তৃতীয় থেকে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রদের দিয়ে। উদাহরণ,
Edgar Allan Poe
Eerie stories and poems
Decorate our imagination. Both
Good and evil
Are challanged along with
Reality.
Also,
Love and insanity
Lurk through the pages and
Anthologies. You will
Never know what is to happen next.
Problems of murder and mystery,
Oddities and wonderment are
Expressed with such peculiarity only he could acheive.
- – - – - Christina M.
কবিতা লিখতে পারবেন কিনা সে প্রশ্নের উত্তরে এটুকু বলবো যে, লেখা শুরু করার প্রাথমিক ধাপগুলো এই প্রবন্ধে আছে। এটাকে আয়ত্ত করে যদি কাজে হাত দেন তবে অবশ্যই কিছু না কিছু একটা দাঁড়াবে। তবে ভালো কবিতা লেখার জন্যে তো নিয়মিত সাধনার দরকার। পর্যাপ্ত পরিমানে পড়াশুনা করা দরকার। সাধনা করলে ভালো লিখতে না-পারার তো কোনো কারণ দেখি না।স্বভাব কবির প্রশ্নে বলবো, এখন আর ওদের যুগ নেই। একটু কঠিন শোনালেও কথাটা সত্য যে জানা এবং সেখান থেকে কিছু একটা তৈরী করার যুগ এটি। এই জায়গাটিতে বিজ্ঞান বা টেকনোলজির সাথে কবিতার একটি চমকার মিল পাই। এই সুযোগে আপনাকে একটি গল্প বলি। আমি গণিতের ছাত্র। এক সময় আমার প্রফেসর, প্রফেসর জ্যাম্বয়েস, জানতে পারলেন যে আমি কবিতা লিখি। এই শিক্ষককে ছাত্ররা যারপরনাই এই মার্কিন দেশেও প্রচণ্ড ভয় করতো। মূলত ফেল করার ভয়। আমি কিন্তু তাঁকে খুব পছন্দ করতাম; এবং তাঁর চার চারটি ক্লাস নিয়েছিলাম। একদিন অনেকের মতো তিনিও জানতে চাইলেন, “গণিত পড়ো আর কবিতা লেখো এটা কিভাবে সম্ভব।আমি বললাম, “কেনো আমি তো কোনো পার্থক্য দেখি না; বরং যথেষ্ট মিল পাই।ধরা পড়ে গেলাম। তাঁকে তখন মিলটি বোঝাবার কাজ করতে হলো। তিনি বুঝলেন, এবং মন্তব্য করলেন, “তোমার মতো পাগল আমি দ্বিতীয়টি দেখি নাই।
এখানেই শেষ নয়। আমার ব্যাচেলর ডিগ্রী শেষ হলে প্রফেসরকে অনুরোধ করলাম একটি রিকমান্ডেশন দিতে আমি যাতে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে পারি। (বলে রাখা ভালো যে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাচেলর করার পর এমএ না করে সরাসরি পিএইচডি কোর্চে ভর্তি হওয়া যায়)। প্রফেসর এবার তাঁর গুটি চাললেন, বললেন, “হ্যাঁ আমি সেটা করবো তুমি যদি আমাকে লিখিত দিতে পারো যে আগামী পাঁচ বছর কবিতা লিখবে না।না, আমার পিএইচডি করা হয়নি। কারণ, কবিতাকে আমি ছাড়তে পারিনি। পরে অবশ্য এমএ করে নিয়েছি। কিন্তু আমার মনে হয়েছে কবিতাকে না ছেড়ে ভালোই করেছি। অন্তত প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাগজে কলমে ঠোকাঠুকি করতে পারছি। এ-ও তো এক প্রকার শান্তি। আপনার জন্যে যদি এই শান্তি প্রযোজ্য হয়, কবিতার জগতে আপনাকেও স্বগত জানাই।
http://0.gravatar.com/avatar/2a63ff2fd44fd98d508e76c75351e623?s=32&d=identicon&r=G
মাহফুজ এর জবাব:
সেপ্টেম্বর ৫, ২০১০ at ১২:৩৩ পূর্বাহ্ণ
@হাসানআল আব্দুল্লাহ,
আপনার লেখা আর মন্তব্য পড়ে আমি অনুপ্রাণিত। আমারও যাত্রা শুরু হলো আপনার দলে। জল পড়ে পাতা নড়ে’ -এর মত শুরু করলাম।
গণিতের ছাত্র,
জানলাম এই মাত্র।
হলেন একজন কবি,
চোখে ভাসে তার ছবি।
লম্বা লম্বা চুল,
নহে এ নজরুল।
নাম তার হাসান,
সবাই করে সম্মান।
বিসমিল্লাহ বলে শুরু,
আজ থেকে উনিই আমার গুরু।
ধন্যবাদ আমার মন্তব্যের প্রত্যুত্তর দেবার জন্য।
  1. 8
সেপ্টেম্বর ৫, ২০১০ সময়: ১০:০৬ পূর্বাহ্ণ লিঙ্ক
@ হাসানআল আব্দুল্লাহ, অনেক কিছু শিখলাম আপনার লেখাটা পড়ে, ধন্যবাদ আপনাকে।
  1. 9
http://0.gravatar.com/avatar/a65a5d31c4a63b443b4f7cdd6c205c3b?s=80&d=identicon&r=Gঅরক্ষিত
সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১০ সময়: ১১:৪৩ পূর্বাহ্ণ লিঙ্ক
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
পুরনো ডায়েরীটা হারিয়ে সবকিছুই হারিয়ে ফেলেছিলাম।
আপনার এই লিখাটা আমাকে আবার উসাহ যোগাবে।
ধন্যবাদ আবারো।
:yes:
  1. 10
মে ৫, ২০১১ সময়: ৭:০৯ পূর্বাহ্ণ লিঙ্ক
অনেক ভাল লেখা, কবিতা বিষয়ে অনেক কিছু শেখার আছে সেটা সবাই জানতেও পারবে এই লেখাটা পরে !
লেখাটা এই ব্লগে http://onukabbo.net/ শেয়ার করে বাংলায় প্রথম পূর্নাঙ্গ কবিতা ব্লগকে সমৃদ্ধ করতে এগিয়ে আসুন।
  1. 11
http://0.gravatar.com/avatar/458d092f8f2f634360da3bb76ca6ca5e?s=80&d=identicon&r=Gবিধুভূষণ ভট্টাচার্য
জুন ২০, ২০১২ সময়: ১২:১০ পূর্বাহ্ণ লিঙ্ক
ছড়া পড়তে এসে পেয়ে গেলাম ছন্দের উপর আপনার লেখা প্রবন্ধগুলি। প্রথম থেকে পড়া শুরু করেছি। আজ এই প্রবন্ধটির স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দ দুটি পড়লাম। অক্ষরবৃত্ত আগামীকাল পড়ব।
শিক্ষনীয় বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনামূলক ‍লেখাগুলি ‍‍‍‍পড়ে শিখতে পারবো, এজন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
প্রবন্ধটি নিয়ে আপনার অভিমত জানান(বাংলা হরফে ও বাংলা ভাষায়)
Top of Form
মুক্তমনা ব্লগ সদস্যরা কমেন্ট করার আগে লগ-ইন করে নিন।
নাম (বাংলা হরফে): *
ইমেইল: *
ওয়েব সাইট:
মন্তব্য:
মন্তব্য করার জন্য http://cdn.omicronlab.com/images/avro5-icon-60.pngভ্র ডাউনলোড করে নিন অথবা নীচের যে কোন একটি বাংলা কীবোর্ড লেআউট ব্যবহার করুন

কমেন্ট করার আগে 'প্রিভিউ' বাটন চেপে দেখে নিন
কমেন্টে ছবি পেস্ট করার জন্য এখানে ক্লিক করুন।
ইউটিউব থেকে ভিডিও সংযোগের জন্য  ভিডিওর URL কপি করুন এবং লিঙ্কটি পোস্ট করার সময় http://  র বদলে httpv:// লিখুন ( 'v' characterটি লক্ষ্য করুন।)
Bottom of Form
  • ব্লগ ঠিকানা
বাংলা ব্লগ

ইংরেজি ব্লগ
  • মুক্তমনার নির্বাচিত বই
http://www.mukto-mona.net/project/book_pic/dhormo_biggan_shomonnoy_sm2.jpg

  • মুক্তমনা ব্লগারেরা
  • লগইন
Top of Form
ব্যবহারকারী:
পাসওয়ার্ড:
ভুলো না আমায়
Bottom of Form
http://www.mukto-mona.com/images/button/icon_rss.gif
পরিকল্পনা ও ডিজাইন: অভিজি রায়; |   Mukto-Mona, since 2001



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন